Sharing is caring!
আব্দুল হালিম সাগর বিশেষ প্রতিবেদন : সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও এসএমপির ফুটপাতে হকার বাণিজ্য আর চাঁদাবাজী বন্ধ করতে বার-বার ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার (এসএমপি) নিশারুল আরিফ । হকারদের ভাষ্যমতে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নাম ভাঙ্গিয়ে হচ্ছে ওপেন চাঁদা উত্তোলন । অপরদিকে এসএমপি কমিশনারের নির্দেশে বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ প্রতিদিন ৩/৪জন ভাসমান হকারকে আটক করে আদালতে দিচ্ছে চালান । এক কথায় ফুটপাত মুক্ত আধুনিক নগরী গড়তে না পেরে যেনো হতাস দুই আরিফ ।
জনশ্রুতি মতে, এক সময় সাবেক প্রয়াত মেয়র বদর উদ্দিন কামরানকে দায়ী করা হতো । কারণ তার অনুসারী রকিবের একক নিয়ন্ত্রনে ছিলো সিলেটের ফুটপাত রাজ্য । সময়ের সাথে সাথে সেই যুগের অবসান হলেও আজও সেই রকিবের নামে উঠে আংশিক চাঁদা । তবে এখন ফুটপাত রাজ্য একক নিয়ন্ত্রণ খোদ মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর আস্থাভাজন জাতীয়তাবাদী হকার্সদলের সভাপতি নুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আহাদের হাতে । অনেক পথচারী ফুটপাত দখল দেখে প্রশ্ন তোলেন নগরীর ফুটপাত এবার কত টাকায় লিজ দিলে দুই আরিফ। যদিও দুজনই নিজেদের অবস্থান থেকে হকারমুক্ত নগরী গড়তে অনড়। দিয়েছেন স্পষ্ট বক্তব্য প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত নগরীর ব্যস্থতম সব কয়টি রোডে বসে হকারদের মিলন মেলা । যদিও পথচারীদের অভিযোগ পুলিশের দিকে। তবে হকারদের কাছ থেকে দিনে রাতে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজী ১৫/১৬ জনের কয়েকটি চক্র। তাদের রাজনৈতীক পরিচয় ভিন্ন হলেও ফুটপাতে চাঁদাবাজীতে তারা ঐক্যজোট। ঈদানিং হর্কার উচ্ছেদ নিয়ে পুলিশ-হকারের (চুর-পুলিশ) খেলাটা বেশ মজাদার। একদিকে উচ্চেদ তো অপর দিকে দখল । সিলেট নগরীর ফুটপাতে হকার সমস্যাটা দীর্ঘদিনের । ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর সিলেটের ফুটপাতের ১৬ জনকে চাঁদাবাজকে চিহ্নিত করে ছবিসহ আদালতে তালিকা দেন মেয়র আরিফ । যার ফলে একমাসের মাথায় আটক হন হকার পরিষদের সভাপতি আব্দুর রকিব। অবশ্য কয়েকদিন পরই তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন । মেয়র আরিফুল হক ফুটপাত দখলমুক্ত করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দিন রাতে লাঠি হাতে রাস্তায় নামেন বেশ প্রশংসা কুড়ান । ২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পুরাতন হকার্স মার্কেটের ভেতরে একটি অস্থায়ী বাজার স্থাপন করেদেন। নগরীর দখলকৃত ফুটপাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় হর্কার বসা নিষেধ সম্বলিত সাইনবোর্ড । শুরুতে হকাররা ওই মার্কেটে ব্যবসা করলেও, এখন সেখানে তাদের সংখ্যা নগণ্য। কিন্তু এখন আর এই সাইনবোর্ডের অস্থিস্ত নেই। সিসিকের ‘অস্থায়ী মার্কেটের’ একটি তালিকা করা নিয়ে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন হকারগণ। বেশি সুবিধার আশায় একপক্ষ মেয়র আরিফের পক্ষ নেয়, আরেক পক্ষ বিরোধিতা শুরু করে । এই পক্ষের সঙ্গে যোগ দেন লাইনম্যান ও চাঁদার টাকার সুবিধাভোগীরা। এই সুযোগে ফুটপাতের চাঁদাবাজীর নতুন নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয় হর্কাসদল নেতা আহাদ-নুরুলগং । হকারমুক্ত রাস্তার জন্য আদালত থেকে বার বার নির্দেশনা আসে। কিন্তু সকল নির্দেশনাই উপেক্ষিত হয় আহাদ-নুরুলের কাছে । আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বারং বার মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও এসএমপি পুলিশ কমিশনার নিশারুল আরিফ দুজনেই এখন ব্যর্থ । তারা চুড়ান্ত হার্ড লাইনে গিয়েও কোন পরিকল্পনায় কাজ হচ্ছেনা । এখন প্রতিদিনই ফুটপাতে পুলিশের দখলমুক্ত এ্যাকশন চলে। পুলিশের গাড়ি দেখলেই হকাররা দৌড়ে পালান, আর চলে গেলে আবার দখল শুরু হয়।
সরেজমিন অনুসন্ধান মতে, নগরীর ফুটপাত থেকে গড়ে প্রতিমাসে আদায়কৃত চাঁদার পরিমান কোটি টাকা । পুলিশ আর মেয়রের নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদা উত্তোলন করে নিজেরাই ভাগবাটোয়ারা করে চাঁদাবাজরা । হকারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন ৫/৬ জন হকারকে আটক করে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ । এ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় সরাসরি পুলিশ এসব চাঁদাবাজদের সাথে নেই। পুলিশ টাকা নিলেতো পুলিশ হকারদের আটক করার কথা নয়! নাকি পুলিশ প্রশাসনের নামে টাকা তুলে রাগব বোয়াল, নেতা-পাতি নেতা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। প্রশ্ন আসে, তা হলে সেই চাঁদাবাজীর টাকা যায় কোথায়?
অনুসন্ধান মতে, সিলেট নগরীর ফুটপাতে চাঁদা উত্তোলনকারীদের নামের শীর্ষে আছেন জাতীয়তাবাদী হর্কাস দলের সভাপতি নুরুল ইসলাম, একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আহাদ। এই দুই রতেœর হাতেই সিলেট নগরীর ১২শত হকার এখন জিম্মি । তারা নিজেদের মেয়র আরিফের ডান হাত হিসাবে পরিচয় দেন।বিনিময়ে মেয়রের যে কোন অনুষ্টান হলে মিছিল সহকারে হকারদের নিয়ে অনুষ্টাতে আসতে হবে,তা ব্যক্তিগত হউক আর সরকার বিরোধী হউক। বন্দরবাজার যাত্রী ছাউনীর আশপাশে চাঁদা তোলে মোমিন, মুমিন নিজেই স্বঘোষিত নেতা । বিপাকে পড়লে বলেন পুলিশের লাইনের টাকা। জিন্দাবাজার একাংশে ‘লেংড়া’ কামাল, দুর্গাকুমার স্কুলের সামনে ছাব্বির, পোস্ট অফিস এলাকায় দাঁড়িওয়ালা একরাম, সিটি কর্পোরেশনের সামনে গেদু, হাসান মার্কেটের সামনে উজ্জ্বল, জিন্দাবাজার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সামনে ফারুক, ক্বিনব্রিজের নিচে রাসেল এবং চৌহাট্টা আল হামরা আশপাশে মিজান । জেলা পরিষদের সামনে শামিম, এরা সবাই নুরুল ইসলাম ও আহাদের লোক। কোর্টপয়েন্টে রাতের পাহারাদারের বেতন বাবদ চাঁদা তোলেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারী ও ‘সাজু’ নামের একজন সুপারভাইজার । লাইনম্যান একরাম ও উজ্জ্বল সাজুর হয়ে চাঁদা তুলেন । তাদের অপর সহযোগী হকার দলের সাবেক ক্যাশিয়ার শাহাজান উরফে প্যান্ট শাহাজান । এদের পাশাপাশি ফুটপাতে চাঁদা উত্তোলন করেন, জাগোপা নেতা শাহাজান সাজু। জাগোপার সভাপতি মকসুদের বক্তব্য, তাদের কর্মী সাজু আগে ফুটপাতে ব্যবসা করলেও এখন তিনি চাঁদাবাজীর সাথে জড়িত নয়। তিনি হকারমুক্ত ফুটপাত গড়ার পক্ষে কাজ করছেন । তবে হকারদের মুখে তার নাম শুনা গেছে । আরেক চাঁদাবাজ পিয়াঁজ ব্যবসায়ী ইউসুফ উরফে (ইয়াবা ব্যবসায়ী ইউসুফ)। যদিও সে নিজে চাঁদাবাজীর সাথে জড়িত নয় বলে দাবী করে । জাতীয়তাবাদী দলকে টেক্কা দিতে মাঠে আছেন শ্রমিকলীগের সাইনবোর্ডধারী ল্যাইনম্যানরা । তারা নিজেরা মহানগর শ্রমিকলীগের সাধারণ সম্পাদক রুমেনের লোক পরিচয় দিলেও রুমেন তা অস্বীকার করেন ।
এক সময় ফুটপাতের নিয়ন্ত্রণ কর্তা হর্কাসলীগ নেতা রকিবের হয়ে মাঠে কাজ করেন সুমন ও জামাল নামের একাধিক ল্যাইনম্যান । রকিব নিজে এখন পাইকারী মাছের ব্যবসা করেন কাজিরবাজার । কিন্তু সেই রকিবের নামে এখনো চাঁদা উত্তোলন চলে কি করে ? এমন প্রশ্নও শুনা যাচ্ছে সচেতন মহলের মুখে । নগরীর সবচেয়ে বেশি ফুটপাত ব্যবসায়ী বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, রাজা ম্যানশন, লালদিঘীরপার, কোর্ট পয়েন্ট, জেলা পরিষদ, হাসান মার্কেট, দু-পাশে ক্বিনব্রিজের নিচ, তালতলা ভিআইপি রোড, রিকাবীবাজার, আম্বরখানা, উপশহর পয়েন্ট এলাকায় । সকাল হলেই বিভিন্ন নামে চাঁদাবাজরা মাঠে নামেন, নিজেদের লাইনম্যান পরিচয় দিয়ে ।
ফুটপাতে কার প্রভাব বেশী: যদিও ফুটপাতে চাঁদাবাজীতে বেশী প্রভাব সিসিকের নামধারী লাইনম্যানদের, তারা তাদের সুবিধামতো মেয়র বা সিসিকের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করতে পারেন। নগরীর ফুটপাতে যেকোন হকার বসতে হলে ‘লাইনম্যান’কে আগে ম্যানেজ করতেই হবে। এখন চাঁদার শতকরা ৭০% উত্তোলন করা হয় সিসিকের নামে। হকার্সদল নেতা নুরুল ও আহাদের স্পষ্ট বক্তব্য মেয়র আরিফুল হকের কাছ থেকে তারা ফুটপাতে হর্কার বসার অনুমোদন নিয়েছেন।
ফুটপাতের কোন লাইনে কত টাকা চাঁদা দিতে হয় : জেলা প্রশাসকের ফটক থেকে জিন্দাবাজার হয়ে রাজাম্যানশন পর্যন্ত প্রতিটি দোকান থেকে ৭০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলা হয়। হাসান মার্কেটের এক নম্বর গেইট থেকে ফলের দোকান প্রতি তোলা হয় ১৫০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা । মধুবন থেকে করিম উল্লাহ মার্কেট প্রাঙ্গণের আশপাশ হয়ে শিশুপার্ক পর্যন্ত প্রতিটি অস্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তোলা হয় ১৫০ টাকা করে । এর আগে করিম উল্লাহ মার্কেট পর্যন্ত চাঁদা তোলতো ডালিম আহমদ। সিটি কর্পোরেশনের মূল ফটকের আশপাশ এলাকা থেকে দোকান প্রতি তোলা হয় ১০০ টাকা, সিটি সুপার মার্কেট থেকে পোস্ট অফিস পর্যন্ত কাঁচামালের প্রতি দোকান থেকে ১০০ টাকা, পেপার পয়েন্ট থেকে লালদিঘীরপাড় ভেতর পর্যন্ত প্রতি সবজি বিক্রেতার কাছ থেকে ৪০ টাকা, পেপার পয়েন্ট থেকে হাফিজ কমপ্লেক্স পর্যন্ত সবজি ও ফলের দোকান থেকে তোলা হয় ৫০ টাকা । বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল ফটকের আশপাশ এলাকা থেকে জেলা পরিষদ ফটকের সামনে থেকে দোকান প্রতি ১০০ টাকা, সার্কিট হাউসের মূল ফটকের সামনে চটপটি, চা বিক্রেতাদের প্রতি দোকান থেকে ৮০ টাকা, কোর্টপয়েন্ট, রেজিস্টিারী মাঠ, কালিঘাট সড়কের ফুটপাতের প্রতি দোকান থেকে প্রতিদিন ৮০ টাকা করে উত্তোলন করা হয় ।
বন্দরবাজার বা থানা পুলিশের স্পষ্ট বক্তব্য: ফুটপাতে চাঁদাবাজীতে পুলিশের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। পুলিশ ফাঁড়ির কোন সদস্যকে সরাসরি চাঁদা তোলতে দেখাও যায়নি কোন দিন । হকার উচ্ছেদে এসএসমপি নির্দেশনা রয়েছে। তবে ফুটপাতের চাঁদাবাজদের গ্রেফতারের কোন নির্দেশনা না থাকায় তাদের গ্রেফতার করা যাচ্ছেনা । অনেকে নিজেদের ধুয়া তুলসিপাতা দাবী করলেও প্রায় দুইশতাধিক হকারের বক্তব্যসহ চাঁদাবাজির অনেক দৃশ্য রয়েছে প্রতিবেদকের কাছে ।
বন্দরবাজার ফাড়ির ইনচার্জ সাজেদুল করিম স্পষ্ট ভাবেই বলছেন, ফুটপাতে চাঁদাবাজির সাথে বন্দর ফাঁড়ির কোন পুলিশ সদস্য জড়িত নয় । অনেকে পুলিশের নামে গুজব ছড়ায়। আজ পর্যন্ত চাঁদা তোলতে ফাঁড়ির কোন সদস্যকে দেখা যায়নি ।
একই বক্তব্য খোদ উত্তর জোনের ডিসি আজবাহার আলী শেখে এর, তিনি বলেন, ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করতে পুলিশ দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে, এ সকল চাঁদাবাজদের সাথে পুলিশের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই ।
সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘চাঁদাবাজির সাথে সিটি কর্পোরেশনের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে, আর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি কমিশনারসহ আমরা খতিয়ে দেখবো ।
এসএমপি পুলিশ কমিশনার মো. নিশারুল আরিফ জানান,‘এসবের সাথে তার অধিনস্থ কোন পুলিশ যাতে জড়িত না হয়, এজন্য কঠোর নির্দেশনা দেয়া আছে । এরপরও যদি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে । সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে তাহলে কি মেয়র ও পুলিশ কমিশনার থেকে এসব চাঁদাবাজদের ক্ষমতার প্রভাব অনেকটা বেশী ।
৫৫১ পড়েছেন