Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিবেদন: এইতো মাত্র কয়েক বছর আগেও মৌলভীবাজার থেকে সিলেটে আশে আব্দুস শহিদ। নগরীতে ফেরি করে বিক্রি করতো মাছ। কিন্তু সিলেটে নগরীর ডাকাত আর ছিনতাইকারীদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে ছিনতাই নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ নিজে হাতে নিয়ে নেয়। এখন সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। নগরীর দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরে রয়েছে শহিদের ৩ তলা বিশিষ্ট একটি আলিশান বাড়ি। যেটি তৈরী করতে শহিদ ব্যয় করে প্রায় ২ কোটি টাকা। প্রথম স্ত্রী ঘরে থাকলেও প্রতারণা করে বিয়ে করেছে আরো কয়েকটি। তবে পরের বিয়ে করো কোন বউকেই সে কাবিন নামা দিতোনা। পরে ১ম স্ত্রী জানলে বা জুট-ঝামেলা হলে টাকা দিয়ে মিটমাট করে নিতো। আজ থেকে কয়েক বছর আগেও শহিদ প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে জৈনপুরে একটি কলোনীতে ৩৫০০ টাকায় বাড়া থাকতো। শহীদের বেশ কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে একাউন্ড বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক, ডাচবাংলা, পূর্বালী ব্যাংকে। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে শহীদ এখন মাছ বিক্রেতা থেকে সকলের কাছে মোবাইল চোর সিন্ডিকেটের গডফাদার শহিদ নামে অতিপরিচিত। সময়ের সাথে সাথে গড়ে উঠেছে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের গভির সখ্যতা। গত শুক্রবার কোতয়ালী থানার ওসির নেতৃত্বে সিলেট নগরী থেকে মোবাইল ছিনতাইকারীদের গডফাদার মৌলভীবাজার জেলার সনকাপন গ্রামের বাসিন্দা মৃত নীল মিয়ার ছেলে ও বর্তমান দক্ষিণ সুরমা থানার জৈনপুর গ্রামের বাসিন্দা এই আব্দুস শহীদকে আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ। অবশ্য আগেও শহিদ র্যাব পুলিশের হাতে একাধিক বার আটক হয়। পরে আদালত তেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায়। সম্প্রতি আটক হওয়ার পর তার দেওয়া তথ্যমতে আটক করা হয় আরো তিনজনকে। আটককৃতরা সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সঙ্গবদ্ধ ভাবে মোবাইল, মহিলাদের ব্যানেটি ব্যাগ, পকেটের টাকা ছিনতাই করে থাকে। এদের বিরুদ্ধে সিলেট এসএমপি বিভিন্ন থানায় একাধিক ছিনতাই মামলাসহ বিভিন্ন রকম মামলা মোকদ্দমা রয়েছে। শহীদকে কেউ চেনেন চোর নামে। কেউ বা ছিনতাইকারী হিসাবে। সিলেটের অপরাধ জগতে বিচরণ করা এই শহীদ এখন ছিনতাই ও ডাকাত নেটওয়ার্কের গডফাদার।
ছিনতাই জগতের গডফাদার শহিদ : নিজে এক সময় মাছ বিক্রি করলেও পরে শুরু করে ছিনতাইয়ের কাজ। তবে এখন নিজে অপারেশনে নামে না। অপারেশন করে তার সহযোগীরা। তবে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে শহীদ নিজে। সারাদিন ব্যস্থ থাকে চোরাইকৃত মোবাইলে আইএমই নাম্বার বদল আর বিক্রি করতে বিভিন্ন মার্কেটে। সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে গ্রেফতার হওয়া কয়েকজন চিহ্নিত ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশ জানতে পারে তাদের গডফাদার শহীদের নাম। দীর্ঘদিন ধরে তার নামটি আড়ালে ছিলো অদৃশ্য কারণে। নতুন করে অপরাধের গডফাদারের নাম আসায় পুলিশ শহীদকে খুঁজছিল। কিন্তু তার হদিস পাচ্ছিল না, কোতোয়ালি থানা পুলিশ জানিয়েছে, সম্প্রতি ডাকাতির প্রস্তুতিকালে নগরীর বন্দরবাজার রংমহল টাওয়ারের কাছ থেকে ডাকাতদের আটক করে পুলিশ। এরপর থানায় জিজ্ঞাসাবাদে তারা গডফাদার হিসেবে জানায় আব্দুস শহীদের নাম। গত শুক্রবার থানার ওসি মোহাম্মদ আলী মাহমুদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম অভিযান শুরু করে। অভিযানের সময় সিলেট শহরতলীর জৈনপুর এলাকার নিজের বাসা থেকে শহীদকে আটক করা হয়। যদিও চতুর শহিদ এই বাসাটি নিজের বলে পরিচয় দেয়না কারো কাছে। কারন বাসার মালিকানা তার ১ম স্ত্রী নামে করে দিয়েছেন কৌশল হিসাবে। এক সময় শহীদের এই স্ত্রীর মা টার্মিনাল এলাকার একটি টং দোকানে ভাত বিক্রি করতো বলে জানা যায়। তবে শহিদের এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ের সন্ধান পেয়েছেন এ প্রতিবেদক। গ্রেফতারের পর থেকে পুলিশ শহীদকে তার অপরাধ নেটওয়ার্ক এবং সহযোগীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। শহীদ তার ৩ সহযোগীর নাম প্রকাশ করে। তবে আড়াল করে তার ভাই ও ভাতিজার নাম এরা দুজনও শহীদের অপরাধ নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত।
সূত্র জানিয়েছে, শহিদের ভাইয়ের আইয়ূব আলীর একটি মোবাইলের দোকান রয়েছে দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। চুরি মোবাইলের আইএমই নাম্বার শহিদ এই দোকানের বদল করে। পরে এখানে ব্যর্থ হলে সিলামে মিজান নামে তার এক বন্ধুর দোকানে আইএমই চেঞ্জ করে শহিদ। শহিদের সকল কু কাজের সহযোগী আল আমিন নামে তার এক ভাতিজা। সবশেষ ব্যর্থ হলে দুই মাসের চোরাইকৃত সকল ফোন একত্রিত করে বর্ডারের ও পাশে ভারতে পাঠিয়ে দেয় বস্তাবন্ধি করে। সূত্র আরো জানায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কার্টন ভর্তি হয়ে চোরাই ফোন আসে শহিদের কাছে। কখনো ট্রেনে কখনো বা বাসে করে এসব ফোন আসে। কারণ সারাদেশ রয়েছে শহিদের একটি চোরাই নেটওয়ার্ক।
কোতোয়ালি থানার ওসি আলী মোহাম্মদ মাহমুদ জানিয়েছেন, এক সময় নিজেই ছিনতাই করতো আব্দুস শহীদ। কয়েক বছর ধরে সে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করে। তার নেটওয়ার্কের কে কোথায় যাবে, কী করবে এসব বিষয়ে তদারকি করে সে। পাশাপাশি কোনো সদস্য গ্রেফতার হলে তাকে ছাড়িয়ে আনার কাজও করতো। ফলে তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশিদিন জেলে থাকতে হতো না। ভয়ঙ্কর অপরাধী শহীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিলেটের কোতোয়ালিসহ বিভিন্ন থানায় ৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে শহীদ দক্ষিণ সুরমার শহরতলীতে অবস্থান করে পুরো নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করতো । আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, মৌলভীবাজার সনকাঁপন গ্রামের বাসিন্দা মৃত নীল মিয়ার ছেলে শহীদ। প্রায় ১৫ বছর ধরে সে সিলেট নগরে বসবাস করছে। দক্ষিণ সুরমা, টুকেরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় সে বসবাস করেছে। প্রথমে বন্দরবাজার এলাকার ছিচঁকে অপরাধী ছিল শহীদ। মোবাইলসহ পথচারীদের পকেট মারের ধান্ধায় ব্যস্ত থাকতো। এসব অপরাধ করতে গিয়ে এরই মধ্যে কয়েকবার ধরাও পড়ে। এক সময় বন্দরবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিভিন্ন রুটে সিএনজি অটোরিকশায় ছিনতাই করতে তার নেতৃত্বে একটি টিম গড়ে ওঠে। ওই টিমের সদস্যরা দিনের বেলা চুরি, ছিনতাই ও রাতে ডাকাতি করতো। ওই সময় মামলাও হয় তার বিরুদ্ধে। পুলিশ জানিয়েছে, নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পর শহীদ দক্ষিণ সুরমায় চলে যায়। ওখানে সে তার বাহিনীতে আরও সদস্য বাড়ায়। এখন তার নেতৃত্বে ১৫-১৬ জনের ছিনতাইকারী দল সিলেট নগরীর নানা অপকর্ম করে বেড়ায়। এসব অপরাধ করতে গিয়ে গত একমাসে কোতোয়ালি পুলিশ ৭-৮ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে । কোতোয়ালি থানার এসআই মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, বন্দরবাজার থেকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া ডাকাত দলের সদস্যরা তাদের গডফাদার হিসেবে শহীদের নাম জানায়। পরে ওই ডাকাতদের ভাষ্যমতে শহীদকে তার দক্ষিণ সুরমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল শহীদকে আদালতে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চায়। তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার অপরাধের পুরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করেন এসআই মিজান। এদিকে, গত শুক্রবার গ্রেফতার হওয়া শহীদের মুখ থেকে তার অপরাধ সিন্ডিকেটের আরও ৩ সদস্যের নাম জানতে পারে পুলিশ। এরপর বিকালে ও রাতে অভিযান চালিয়ে তার সহযোগী ৩ জনকেও গ্রেফতার করা হয়। এরাও হচ্ছে সিলেট নগরের পরিচিত মোবাইল চোর ও ছিনতাইকারী। নগরের শেখঘাট, বন্দরবাজার, টুকেরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় তারা ছিনতাই করে বেড়ায়।
পুলিশ জানায়, শফিকের দেয়া তথ্যমতে আটক করা হয় ভয়ঙ্কর অপরাধী সুনামগঞ্জের ছাতক থানার জিগলী রাইতলা গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে শফিক মিয়াকে। তবে এই আব্দুস শহিদ তার সাথে আটক হওয়া শফিক মিয়ার ভাই আলী হত্যার মামলার ৩নং আসামী ছিলো। পরে নিজেকে তাদের কাছে নির্দোষ দাবী করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মামলা থেকে নিজের নামটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে প্রলোভনে ফেলে কাবিন ছাড়াই বিয়ে শফিকের বোনকে । কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামান্নার সাথে ছাড়াছাড়ি হলে বিচার শালিশে মাত্র ১ লাখ টাকা দিয়ে শহিদ দায়মুক্তি পায়। এর পর থেকে শহিদের রুশানলে পড়ে ঐ স্ত্রীর পরিবার । একে একে সাবেক স্ত্রীর ভাইদের বানায় ছিনতাই মামলার আসামী। এই থেকে শহীদের ভাষ্যমতে সাবেক স্ত্রী তিন ভাইয়েরা সকলেই এখন ছিনতাই মামলার আসামী। যদিও বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কমিশনার বরাবরে লিখিত অভিযোগ করে ঐ স্ত্রীর পরিবার আটক হওয়া পর্যন্ত শফিক বর্তমানে দক্ষিণ সুরমা ও জালালাবাদ থানার বাদেয়ালী এলাকায় বসবাস করছিল। পরে নগরীর থানার খুলিয়াপাড়া নীলিমা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা গেদন মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া ও দক্ষিণ সুরমা এলাকার বরইকান্দি এলাকার কুটি মিয়ার ছেলে পাবেল ওরফে আল আমিনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সঙ্ঘবদ্ধভাবে মোবাইল, মহিলাদের ভ্যানেটি ব্যাগ, পকেটের টাকা ছিনতাই করে থাকে। ওসি জানান, শফিকের নেতৃত্বে থাকা ছিনতাইকারীরা যেসব মোবাইল ছিনতাই করতো সেগুলোর আইএমআই নাম্বার তারা কৌশলে পরিবর্তন করে ফেলে। এরপর ছিনতাই করা এসব মোবাইল তারা সিলেটের বন্দরবাজার, আম্বরখানা চায়না মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে। যদিও পুলিশ বলছে গডফাদার শহীদের তথ্যমতে তার অপর সহযোগীদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চলছে।
৪৭৯ পড়েছেন