Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিনিধি : নানা সংকটে থমকে আছে প্রবাসী অধ্যূষিত বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অন্যতম সম্ভাবনায় বিনিয়োগ খাত আবাসন ব্যবসা। করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে অর্থনৈতিক মন্দা ও ক্রেতার অভাবে সংকটের বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে সম্ভাবনাময় ব্যবসাটি। এ যেনো আবাসন ব্যবসার মহামারি চলছে। নতুন করে নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এখাতে সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা পড়েছেন শঙ্কায়। দেশের আবাসন খাতের ওপর দিয়ে টানা ২ বছর গেছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের বড় ধাক্কা। ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত ও শিক্ষা কার্যক্রমের মতো আবাসনেও স্থবিরতা দেখা দেয়। এ কারণে দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ ছিল বহু প্রকল্পের নির্মাণকাজ। করোনার প্রভাব সামলে ধীরে ধীরে চাঙা হতে শুরু করেছে আবাসন শিল্প। গেল বছরের শুরুতেই আবাসন মেলা বাবদ অর্ডার আসে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। এতে স্বস্তি ফেরে খাত সংশ্লিষ্ট আরও প্রায় ২৬৯টি লিংকেজ কোম্পানিতে। তবে এই স্বস্তি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। হু-হু করে বেড়ে যায় নির্মাণ সামগ্রীর দাম। নির্মাণের অন্যতম উপাদান রডের দাম (প্রতি টন) ইতিহাসে প্রথমবার ১ লক্ষ টাকা ছাডিয়ে যায়। অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হয় বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল। টাইলসের দাম বেড়েছে ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত। সিমেন্টের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দেয় বছর জুড়েই। তেমন প্রভাব না পড়লেও দাম বাড়ার সুযোগে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় ইট, বালু ও পাথরের। দামের এসব প্রভাব পড়ে ফ্ল্যাটের ওপর। মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায় আবাসন খাত। দাম বেড়ে যায় ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্টের। বর্ধিত দামের কারণে বিক্রি কমে অর্ধেকে নেমে আসে। জানা যায়, নানা সংকটে সিলেটের আবাসন সংশ্লিষ্ট খাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়েছে। আবাসন কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক মন্দা আর ক্রেতা সংকটে ভ‚গছে। দেশে নির্মাণসামগ্রীর চড়া দাম ও প্রবসী বিনিয়োগ তুলে নেয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সিলেটে আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় অনেক প্রবাসী আবাসন খাতে বিনিয়োগের পরিবর্তে গ্যাসলাইন আছে এমন পুরাতন বাসা ক্রয়ে আগ্রহী হচ্ছেন। সিলেট অ্যাপার্টমেন্ট অ্যান্ড রিয়েল এস্টেট গ্রুপ (সারেগ) সূত্র জানিয়েছে, একে একে এ সংগঠন থেকে আবাসন কোম্পানিগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে। ১২ বছরের ব্যবধানে সংগঠনের সদস্য ১১০টি কোম্পানির ৯০টি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০-এ। সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, প্রবাসীদের তৃতীয় প্রজন্ম দেশের প্রতি আগ্রহী না হওয়া এবং ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ প্রবাসীদের আয় কমে যাওয়া সিলেটে এ শিল্পের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরাও ঋণে জর্জরিত। অথচ সিলেটের আবাসন ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল এ অঞ্চলের রেকর্ড। প্রবাসীদের ওপর নির্ভর করে চলতি শতাব্দীর শুরুর দিকে সিলেটে গড়ে ওঠে শতাধিক আবাসন প্রতিষ্ঠান। নগরীর আশপাশ এলাকা দিয়ে ঘুরলেই চোখে পড়ত বিভিন্ন হাউজিং কোম্পানির বড় বড় বিলবোর্ড। এর মধ্যে অনেকগুলো আবাসন প্রকল্পের উদ্যোক্তা ছিলেন প্রবাসীরা। বৈশ্বিক মন্দা এসে ধাক্কা দিলে প্রবাসীরা এ খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। তুলে নেন বিনিয়োগ। নতুন করে ফ্ল্যাট ক্রয়-বিক্রয়ও বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে করোনায় লÐভÐ করে দিয়েছে এ শিল্পকে। বাধ্য হয়ে অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। সারেগ সূত্র জানায়, ২০১০ সালে এ সংগঠনের সদস্য ছিল ১১০টি কোম্পানি। ১২ বছরের ব্যবধানে এখন সেটি কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ২০টিতে। পাশাপাশি বিনিয়োগ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। নতুন করে এখাতে আর বিনিয়োগের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে না। গত মাসে সারেগ মেলার পর আবাসন ব্যবসার পালে হাওয়া লেগেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ২০১১ সালে সিলেটে প্রথম আবাসন মেলা করে সারেগ। তখন এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৭১। এরপর ২০১৩ সালের আবাসন মেলা চলাকালে সদস্য ছিল ৫৮টি। সর্বশেষ ২০২৩ সালের আবাসন মেলায় তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠানে। দীর্ঘ এ পরিক্রমায় কেউ কেউ হুজুগে মনোভাব নিয়ে আবাসন ব্যবসায় নেমে সুবিধা করতে না পেরে ব্যবসা গুটিয়ে নেন। আবার কেউ কেউ কোম্পানির পরিচালকদের মধ্যে জমি ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন। জানা গেছে, সিলেটের আবাসন প্রকল্পের সংশ্লিষ্টরা খাতটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এর অংশ হিসেবে গেল ফেব্রæয়ারী মাসের শেষের দিকে ১০ বছর পর সিলেটে ৩ দিনব্যাপী আবাসন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় গ্রাহকদের ব্যাপক সাড়া পেয়েছেন বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আয়োজকবৃন্দ। প্রচার-প্রচারণার কারণে দেশের বাইরে থেকেও অনেক ক্রেতা প্লট-ফ্ল্যাট ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মেলায় অংশগ্রহণকারী স্টলসমূহে অনেক কাস্টমারই তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন। আবাসন শিল্পে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা ছিল, মেলার মাধ্যমে তা অনেকটাই দূর হয়েছে। এর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে প্লট-ফ্ল্যাটের নতুন গ্রাহক তৈরী হবে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও মেলা অনেকটাই সফল বলে আয়োজকদের দাবি। প্রসঙ্গত, মেলায় আর্ক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড, আপন এসোসিয়েটস, হলি আরবান প্রপার্টিজ লিমিটেড, হিলসাইড অ্যাপার্টমেন্টস লিমিটেড, হিলভিউ, আল ফালাহ, ড্রিমল্যান্ড প্রপার্টিজ, সিলকো হোমস, সাকের অটো ব্রিকস, আহমদ ডোর, মেট্রো এসোসিয়েটস এবং এশিয়ান পেইন্টস অংশ নেয়। সিলেট শহরতলির কুশিঘাট এলাকায় একসময় গড়ে তোলা হয়েছিল শ্যামল ছায়া হাউজিং প্রাইভেট লিমিটেড। কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুল ইসলাম জানান, পরিচালক ও শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে সমন্বয় করে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। একটা সময় ব্যবসা চাঙ্গা ছিল, পরে পরিস্থিতি বিরূপ হলে কোম্পানি এ সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে গাজী বুরহান উদ্দিন (রহ.) মডেল টাউন নামে একটি আবাসিক প্রকল্পের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের প্লট বুঝিয়ে দিতে না পারা নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেটে সবচেয়ে বৃহৎ দুটি আবাসন কোম্পানি রয়েল সিটি ও সোনারগাঁ আবাসিক প্রকল্প। বিশাল বিনিয়োগ থাকলেও এ দুটি প্রকল্প এখনো দাঁড়াতেই পারেনি। সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমা এলাকায় ‘রয়েল সিটি’ আবাসন প্রকল্পের অবস্থান। অন্যদিকে ছোটবড় বেশকিছু হাউজিং কোম্পানি গড়ে ওঠে শহরতলিতে। যেগুলোয় প্লট বিক্রি দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ। এজন্য অনেকে হুজুগে উদ্যোক্তাদের দায়ী করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটের যারা বিনিয়োগকারী ছিলেন তাদের অনেকেই সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আবাসন ব্যবসায় স্থবিরতা নেমে আসায় যে কেবল বিনিয়োগকারীরাই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তা নয়, বরং সিলেট অঞ্চলে কর্মসংস্থানেও স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর বাইরে বিশ্বমন্দা ও করোনা পুরো আবাসন খাতকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে অনেক আবাসন প্রকল্পে প্লট বিক্রি বন্ধ। পুরনো কিস্তিও নিয়মিত আদায় হচ্ছে না। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে অনেকেই ব্যবসা থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। সারেগের সাবেক সভাপতি হাসিন আহমদ মনে করেন, কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হলেও সিলেটে আবাসন ব্যবসা পরিকল্পনাহীনভাবে অনকেটা হুজুগে গড়ে উঠেছে। যে যেখানে পারছে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এছাড়া অনেকেই আবাসনের নামে ঋণ এনে অন্য খাতে টাকা ব্যয় করেছে। সেখানে লাভবান হতে না পেরে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এসব কারণেও ব্যবসায় মন্দা দেখা দেয়।
৩৯৪ পড়েছেন