Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিবেদন: নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির মধ্যে সম্প্রতি বেড়েছে বিদ্যুৎ ও সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। এতে জনজীবনে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। নিত্যপণ্যও বাজারেও লেগেছে আগুন। পবিত্র রমজান মাসকে টার্গেট করে এরই মধ্যে সিলেটে ওষুধের বাজার হয়ে পড়েছে লাগামহীন। গত ১ সপ্তাহে অন্তত ২০টির ওষুধের দাম বেড়েছে ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত। সরকারের নির্দেশনার পরও দেশে ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতা থামছে না। কোম্পানিগুলো উৎপাদন ব্যয় বাড়ার নানা অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছেমতো বাড়িয়ে চলছে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে অন্তত ২০টি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বেড়েছে ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত। এসব ওষুধের মধ্যে রয়েছে-সর্দি কাশি জ্বরের ক্যাপসুল ও সিরাপ, গ্যাস্ট্রিক, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস রোগীর ইনসুলিন এবং অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ। এর মধ্যে এমন কিছু ওষুধ আছে যা গত দুই মাসে তিন দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত সপ্তাহে গ্যাস্ট্রিকের যে ক্যাপসুলের পাতা ১৫০ টাকায় বিক্রি হতো বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা। অর্থাৎ পাতা প্রতি দাম বেড়েছে ২০ টাকা। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে অন্তত শতাধিক ওষুধের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। সরেজমিনে ঘুরে নগরীর বিভিন্ন মেডিকেল-হাসপাতাল, ফার্মেসী ও পাড়া-মহল্লার ওষুধের দোকান ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় কোম্পানিগুলো ইচ্ছে মাফিক ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। যে ওষুধের দাম এখনও বাড়ানো হয়নি সেগুলোর দাম বাড়ানোর জন্য কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় এসব ওষুধের দামও বাড়ানো হবে। রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম নিয়েই মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের নাভিশ্বাস , সেখানে ওষুধের দাম এভাবে বাড়ায় রোগী নিয়ে পরিবারগুলো আরও বেশি বিপাকে আছে। এতে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার কথা থাকলেও অনেকে নিরুপায় হয়ে অনিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন। উচ্চমূল্যের কারণে অনেকে এখন খুব বেশি জরুরি না হলে ওষুধ খাচ্ছেন না। সরকারের নির্দেশনার পরও এভাবে ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়টি ‘অযৌক্তিক ও অন্যায়’ বলছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা প্রশ্ন তুলছেন, ওষুধ কোম্পানিগুলো কি লোকসানে চলছে? যদি লোকসান না হয়, তবে এভাবে দাম বাড়ানো যুক্তিযুক্ত নয়। ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে গত ২৭ ফেব্রæয়ারি সচিবালয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক চিরুনি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা.সামন্ত লাল সেনসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বাস্থ্য ও ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে ওষুধ ও হার্টের রিংয়ের দাম কমাতে নির্দেশ দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়ায় আমরা যাইনি। ওষুধের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে। দাম কমাতেই হবে।’ এদিকে শনি, রবি,সোমবার সিলেটের বিভিন্ন বাজারে সরেজমিনে ঘুরে এর বিপরীত চিত্র পাওয়া গেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার ওষুধের দোকানিরা জানান, গত এক সপ্তাহের ভিটামিন, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনসহ অন্তত ২০টি ওষুধের দাম বেড়েছে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ। আর গত দুই মাসে অন্তত শতাধিক ওষুধের দাম ৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি এসেনশিয়াল ড্রাগের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এরমধ্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকায় রয়েছে ২১৯টি। তার মধ্যে ১১৭টি ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। অথচ একসময় দুইশর বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার। সেই সংখ্যা এখন কমে গেছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্য যে সব ওষুধের দাম বেড়েছে তা হলো-গ্যাস্ট্রিক ও আলসারে ফ্যামোম্যাক্স ২০ মিলিগ্রাম এক পাতার ১০টি ক্যাপসুল ২০ থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়েছে, আর ফ্যামোম্যাক্স ৪০ মিলিগ্রাম ১০টির প্রতি পাতা ৩০ থেকে বেড়ে ৫০ টাকা হয়েছে। আগে এক বক্সের দাম ছিল ৩০০ টাকায়, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫০০ টাকা। বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। গ্যাস্ট্রিকের প্রোগ্যাভি ২০০ এমএল সিরাপ ২৫০ থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ২০ শতাংশ। টার্বোক্লাভ ৫০০ এমজি প্লাস ১২৫ এমজি প্রতি পিস ক্যাপসুল ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা হয়েছে। এক পাতার ৪টির দাম ২০০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪০ টাকা। বেড়েছে ২০ শতাংশ। ফিক্সোলিন ২০০ মিলি গ্রাম ট্যাবলেট এক পাতার ১০টির দাম ৭০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা এবং ফিক্সোলিন ৪০০ মিলি গ্রামের দাম প্রতি পাতা ১০০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা। ট্রায়োসিম ২০০ মিলি গ্রামের এক পাতার ১০টির দাম ৩৫ টাকা থেকে ১০ বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে। ব্যাথানাশক ক্যাপসুল রিলেনটাস ২ এমজি প্রতি পিস ৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮ টাকা এবং ১০টির এক পাতা ৫০ থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। এই ওষুধের দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ নার্ভালিন ৭৫ মিলি গ্রামের এক পাতা ১০টি ক্যাপসুল ১৬০ থেকে বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা। একই রোগের গিøপিটা ৫০ মি.গ্রাম ক্যাপসুল প্রতি পিস ১৩ থেকে বেড়ে ১৬ টাকা এবং প্রতিবক্স দাম ৩৯০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ২৩ শতাংশ। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ ট্রানেটা এম ২.৫ মি. প্রতি পিস ১২ টাকা থেকে বেড়ে ১৩ টাকা, হৃদরোগের জন্য ব্যবহৃত রসুটিন ১০ মিলিগ্রামের এক পাতার ১৫ টির দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা, মেটাজিন এম আর এক পাতা ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা হয়েছে। গ্যাস্টিকের ক্যাপসুল অথেরা ৪০ মিলিগ্রাম এক পাতা ১০ টির দাম ১৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭০ টাকা। প্রতি পাতার দাম বেড়েছে ২০ টাকা। এক বক্সের দাম (৩০ টি) ৪৮৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫১০ টাকা। বেড়েছে ৫ শতাংশ। নিওবিয়ন ভিটামিন বি-১ বি-৬ এবং বি ১২ প্রতি বক্স (৬০ টি) ৬৩৩ টাকা ৩৩ পয়সা থেকে দাম বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭২০ টাকায়। ক্যালসিয়াম ফসিক্যাল-ডি ৫০০ মি.গ্রা+২০০ আইইউ প্রতি ১০টির এক পাতা ১১০ টাকা থেকে বেড়ে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২ মাসে আগে প্রতি পাতা ১০০ টাকায় বিক্রি হতো। গত জানুয়ারি তা ১০ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা হয়। ক্যালসিয়াম ফসিক্যাল-ডিএক্স ৬০০ মি.গ্রা.+৪০০ মি.গ্রা আইইউ প্রতি বক্সের দাম ৪৪৮ টাকা থেকে বেড়ে ৫১০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাপসুল অপটিমক্স ৪০০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট ১ মাসের ব্যবধানে দুই দফায় দাম বেড়েছে। গত জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে এক বক্স বিক্রি হয়েছে ৬৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা। পরে তা বেড়ে ৭০০ টাকা হয়। আর গত এক সপ্তাহে প্রতি বক্সের দাম আরও ২০ টাকা বেড়ে ৭২০ টাকা হয়েছে। ভিটামিনের এরিস্টো গোল্ড ট্যাবলেট প্রতি ক্যাপসুল ১২ থেকে বেড়ে ১৩ টাকা হয়েছে। ৩০ টির প্রতি বক্সের দাম ৩৪৩ টাকা থেকে বেড়ে ৩৯০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ১৪ শতাংশ। হাঁপানি ও অ্যালার্জিজনিত সমস্যার জন্য স্ট্যাফেন ১ মিলিগ্রাম ৪০টির এক বক্সের দাম ৩৫২ থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে। বেড়েছে ১৪ শতাংশ। মুখের ক্ষতের সমস্যার জন্য এরোডিন সল্যুশন এক লিটারের বোতল ৭০৪ টাকা থেকে বেড়ে ৮০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ১৪ শতাংশ। কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় অ্যাভোল্যাক ওরাল সল্যুশন ২০০ এমএল ২৮১ টাকা থেকে বেড়ে ৩২০ টাকা হয়েছে। এজেড ২৫০ মি.গ্রা. এক পাতার ক্যাপসুল ২৬৪ টাকা থেকে বেড়ে ৩০০ টাকা এবং এজেড ৫০০ মি.গ্রা. এক পাতার ক্যাপসুল ৫৮০ টাকা থেকে বেড়ে ৬৬০ টাকা হয়েছে। আফরিন পেডিয়াট্রিক ন্যাসাল ড্রপস ১০ মিলিগ্রাম ৫৭ টাকা থেকে বেড়ে ৬৫ টাকা হয়েছে। সিলেট নগরীর মেডিকেল রোড এলাকার এক ফার্মেসী ব্যবসায়ী বলেন, নতুন বছরে প্রায় সব ওষুধের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। প্রথমে বড় বড় কোম্পানির ওষুধের দাম বাড়ে। তা দেখে পরে ছোট ছোট কোম্পানিগুলোও দাম বাড়ায়। অথচ বিক্রি করতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় আমাদের।অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিক, ভিটামিনসহ অনেক ওষুধের দাম বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। কোনটা রেখে কোনটার নাম বলব। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে আমদানি করা বিভিন্ন ওষুধের দাম। একাধিক ফার্মেসির কর্মীরা জানান, নতুন বছরে যেসব ওষুধের দাম এখনও বাড়েনি তা বাড়াতে এরই মধ্যে আমাদের মোবাইলে মেসেস পাঠাচ্ছে কোম্পানিগুলো।
ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প মালিক সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন করে দাম বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে এখনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে অনেক দিন ধরে আলোচনা চলছে। কারণ ওষুধের সব কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্ব বাজারে এসব কাঁচামালের দাম বেড়েছে। সেইসঙ্গে ডলারের দামও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা ওষুধের কাঁচামাল কিনতে ব্যাংকে এলসি খুলতে পারছে না। আবার খুলতে গেলেও নানা ধরনের ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। ওষুধের উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্য বৃদ্ধি, পরিবহনসহ অন্যান্য খরচ বেড়েছে। এ অবস্থায় ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই হয়তো কিছু ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে।
৩৪১ পড়েছেন