Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিবেদন: নাম আব্দুস শহিদ। তবে সকলেই চিনেন শহিদ নামেই।বাড়ি মৌলভীবাজারের মৌলভীবাজার সনকাঁপন গ্রামে। পিতার নাম মৃত নীল মিয়া। দরিদ্র পরিবারে জন্ম। পেশা ছিলো ফেরি করে মাছ বিক্রি করা । কয়েক বছর আগে আসে সিলেট শহরে। পাড়া মল্লাহ ফেরি করে বিক্রি করতো মাছ। লোভে পড়ে জড়িয়ে পড়ে ছিনতাই কাজে। হয়ে উঠে নগরীর ঝাপটা পার্টির সদস্য। ছিচঁকে ছিনতাইকারী হিসাবে ভালোই কামাই করে। এক সময় হয়ে উঠে নগরীর ছিনতাইকারীদের গডফাদার। আশ্রয়-প্রশ্রয় দাতা হিসাবে জেল থেকে আটক ছিনতাইকারীদের ছাড়িয়ে নিজের দলে ভিড়ানো শুরু করে। সময়ের সাথে সাথে বেশভুষা পাল্টে এখন সে নগরীর ছিনতাইকারী ও ডাকাত দলের গডফাদার। এক সময় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো দক্ষিণ সুরমা, টুকেরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায়। সর্বশেষ কোটি টাকার জমি কিনে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যায়ে সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরে গড়ে তুলে বিশাল অট্টালিকা। বাসার চারপাশে লাগানো হয় সিসি ক্যামেরা। বিয়ের রেকর্ডও একাধিক। তবে প্রথম বউ ছাড়া অন্য কোন বউকে কাবিন দিতোনা চতুর শহিদ। পুরুষ ছিনতাইকারী চক্র ছাড়াও মহিলা ছিনতাইকারী চক্র নিয়ন্ত্রণ করে শহিদ। কমলা ও পপি গ্রুপের সাথে রয়েছে তার সখ্যতা। শহিদ এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। তাই প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাদের সহজে ম্যানেজ করে নিয়েছে। ফলে সে সব সময় ছিলো অধরা। যদিও এর আগে শহিদ র্যাবের হাতে একবার আটক হয়। সর্বশেষ চলতি মাসে ওসি কোতয়ালী তাকে আটক করেন। বিভিন্ন অভিযানে এ পর্যন্ত ২০ ছিনতাইকারীকে আটক করেছে এসএমপির কোতয়ালী থানা ও বন্দরবাজার ফাঁড়ির পুলিশ। আটক সকল ছিনতাইকারীই তাদের গডফাদার হিসাবে শহীদের নাম বলে পুলিশের কাছে । তারা সকলেই শহীদের নেতৃত্বে নগরীতে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি,ঝাপটা পার্টির হয়ে কাজ করতো। তবে এখনো সম্প্রতি কোন অভিযানে মহিলা ছিনতাইকারী আটক না হওয়ায় তাদের গডফাদার যে শহীদ সেটা প্রকাশ পাওয়ার অপেক্ষায়। প্রশাসনের নজর এড়াতে বাড়ির জমি লিখে নিয়েছে প্রথম স্ত্রীর নামে। অথচ এই স্ত্রীর মা ২ বছর আগেও সিলেট টার্মিনালের টং দোকানে ভাত ও চা বিক্রি করতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সম্প্রতি আটক হওয়ার পর তার দেওয়া তথ্যমতে আটক করা হয় আরো ২০জন ছিনতাইকারীকে। আটককৃতরা সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সঙ্গবদ্ধ ভাবে মোবাইল, মহিলাদের ব্যানেটি ব্যাগ, পকেটের টাকা ছিনতাই করে থাকে। এদের বিরুদ্ধে সিলেট এসএমপি বিভিন্ন থানায় একাধিক ছিনতাই মামলাসহ বিভিন্ন রকম মামলা মোকদ্দমা রয়েছে। শহীদের নেতৃত্বে নগরীতে কাজ করে ১০/১২ জনের মহিলা ছিনতাইকারী একটি বড় সিন্ডিকেট। তবে শহীদকে কেউ চেনেন চোর নামে। কেউ বা ছিনতাইকারী হিসাবে। সিলেটের অপরাধ জগতে বিচরণ করা এই শহীদ এখন ছিনতাই ও ডাকাত নেটওয়ার্কের গডফাদার। শহীদ এখন নিজে ছিনতাই করেনা। তার নির্দেশে সকাল হলেই মাঠে নামে তার চক্রের সদস্যরা।
তবে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে শহীদ নিজেই। সে সারাদিন ব্যস্থ থাকে চোরাইকৃত মোবাইলের আইএমই নাম্বার রদ-বদল আর বিক্রিতে ব্যস্থ। সূত্র জানিয়েছে, শহিদের ভাই আয়ুব আলী শুভর একটি মোবাইলের দোকান রয়েছে দক্ষিণ সুরমা এলাকায়। শহরের সকল চুরাই মোবাইলের আইএমই নাম্বার দোকানেই পরির্তন করা হয়। তবে শহীদ দোকানে না গিয়ে মোবাইলগুলো আনা নেওয়া করায় আল আমিন নামে তার এক সহযোগীর মাধ্যমে। সেখানে আইএমই পরিবর্তনে ব্যর্থ হলে মোবাইলগুলো সিলাম এলাকায় শহীদের বন্ধু মিজান আইএমই বদল করে দেয়। আটক শহীদসহ ছিনতাইকারীদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছেন কোতয়ালী থানার এসআই মিজান। আগামী ২/১ দিনের মধ্যে হবে আসামীদের রিমান্ড শুনানী। তবে আইএমই চেঞ্জ করতে ব্যর্থ হলে দুই মাসের চোরাইকৃত সকল ফোন একত্রিত করে বর্ডারের ও পাশে ভারতে পাঠিয়ে দেয় বস্তাবন্ধি করে।
সূত্র আরো জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কার্টন ভর্তি হয়ে চোরাই মোবাইল ফোন আসে শহিদের কাছে। কখনো ট্রেনে কখনো বা বাসে করে এসব ফোন আসে। কারণ সারাদেশ রয়েছে শহিদের একটি চোরাই নেটওয়ার্ক কানেকশন। কোতোয়ালি থানার ওসি আলী মোহাম্মদ মাহমুদ জানান, মাছ বিক্রি বাদ দিয়ে এক সময় নিজেই ছিনতাই করতো আব্দুস শহীদ উরফে শহীদ। কয়েক বছর ধরে সে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করে। তার নেটওয়ার্কের কে কোথায় যাবে, কী করবে এসব বিষয়ে তদারকি করে সে। পাশাপাশি কোনো সদস্য গ্রেফতার হলে তাকে ছাড়িয়ে আনার কাজও করতো। ফলে তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশি দিন জেলে থাকতে হতো না। ভয়ঙ্কর অপরাধী শহীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিলেটের কোতোয়ালিসহ বিভিন্ন থানায় ৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করা হয়। নিজে গ্রেফতার এড়াতে শহীদ দক্ষিণ সুরমার শহরতলীতে অবস্থান করে পুরো নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করতো। বিভিন্ন রুটে সিএনজি অটোরিকশায় ছিনতাই করতে তার নেতৃত্বে একটি টিম গড়ে ওঠে। ওই টিমের সদস্যরা দিনের বেলা চুরি, ছিনতাই ও রাতে ডাকাতি করতো। ওই সময় মামলাও হয় তার বিরুদ্ধে। পুলিশ জানিয়েছে, নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার পর শহীদ দক্ষিণ সুরমায় চলে যায়। ওখানে সে তার বাহিনীতে আরও সদস্য বাড়ায়। এখন তার নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের ছিনতাইকারী একটি দল সিলেট নগরীর নানা অপকর্ম করে বেড়ায় প্রকাশ্য। এসব অপরাধ করতে গিয়ে গত এক মাসে কোতোয়ালি পুলিশ প্রায় ২০/২৫ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে। তবুও বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার এলাকার মোবাইল ছিনতাই রোধ করতে পারছেনা পুলিশ।
কোতোয়ালি থানার এসআই মিজানুর জানান, নগরীর বন্দরবাজার থেকে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া ডাকাত দলের সদস্যরা তাদের গডফাদার শহীদের নাম বলে। পরে ওই ডাকাতদের ভাষ্যমতে শহীদকে তার দক্ষিণ সুরমার জৈনপুর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। শহীদকে আদালতে হাজির করে পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চায়। তাকে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার অপরাধের পুরো তথ্য পাওয়া যাবে বলে মনে করেন এসআই মিজান।
সূত্র আরো জানায়, শহীদ একাধিক বিয়ে করেছে এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ের খবর পাওয়া গেলে একটি বিয়ের কাবিন রয়েছে। বাকিগুলো কাবিন ছাড়া বিয়ে ছিলো। প্রথম স্ত্রীর চাপে পরে টাকা দিয়ে মিটমাট করে নেয়। এক সময় শহীদ বিয়ে বরে সুনামগঞ্জের ছাতক থানার জিগলী রাইতলা গ্রামের নুর উদ্দিনের মেয়েকে। কিন্তু কোন কাবিন নামা করেনি বিয়ের। এ বিয়ে বেশি দিন না ঠিকলে নুর উদ্দিনের তিন ছেলেই শহীদের বিরোধীতায় এখন একাধিক করায় ছিনতাই মামলার আসামী। এই আব্দুস শহিদ তার সাথে আটক হওয়া শফিক মিয়ার ভাই আলী হত্যার মামলার ৩নং আসামী ছিলো। পরে নিজেকে তাদের কাছে নির্দোষ দাবী করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে মামলা থেকে নিজের নামটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে প্রলোভনে ফেলে কাবিন ছাড়াই বিয়ে শফিকেদের এক বোনকে। শেষ পর্যন্ত ঐ স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হলে বিচার শালিসে মাত্র ১ লাখ টাকা দিয়ে শহিদ দায়মুক্তি পায়। এর পর থেকে শহিদের রুশানলে পড়ে মেয়েটির পরিবার।
ওসি আরো জানান, শহীদের নেতৃত্বে থাকা ছিনতাইকারীরা যেসব মোবাইল ছিনতাই করতো সেগুলোর আইএমআই নাম্বার তারা কৌশলে পরিবর্তন করে ফেলে। এরপর ছিনতাই করা এসব মোবাইল তারা সিলেটের বন্দরবাজার, আম্বরখানা চায়না মার্কেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে। যদিও পুলিশ বলছে গডফাদার শহীদের তথ্যমতে তার অপর সহযোগীদের গ্রেফতারে পুলিশ অভিযান চলছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ১৮/২০ জন ছিনতাইকারীকে আটক করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে আগের মামলা মোকদ্দমা ছাড়াও নতুন করে পুলিশ বাদী হয়ে একাধিক মামলা দায়ের করেছে।
৪৬৬ পড়েছেন