Sharing is caring!
আব্দুল হালিম সাগর বিশেষ প্রতিবেদন: সিলেট শহরতলীর শাহপরান থানার পীরেরচক কিশোরীগুল স্কুলটুলা নামক স্থানে অবৈধ ভাবে টিলার মাটি কাটায় বাধা দেয়ায় প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয় এক সন্তানের জনক আশিক মিয়াকে। নিহত আশিক পীরেরচক কিশোরীগুল স্কুলটুলা গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে। এ ঘটনাটি গত রোববার (১৯ মার্চ) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ঘটে অবৈধ ভাবে টিলা কাটার স্থলে ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অবৈধ ভাবে মাটি কাটার মেশিন (এস্কেভেটর বা ভেকু) দিয়ে আশিকের বুকে আঘাত করা হলে ঘটনাস্থলেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। যদি লোকজন উদ্ধার করে তাকে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে গেলে ডাক্তার থাকে মৃত ঘোষণা করেন। মাটি কাটাসহ ঘটনার সাথে বেশ কয়েকজন জড়িত থাকলেও পীরেরচক গ্রামের মনহর আলী মনু মিয়ার ছেলে ইসরাব আলী (৫০) ও মাহমুদ হোসেন (৪৫), একই এলাকার খুরশেদ আলম (৩৫) কে আসামী করে নিহত আশিকের ছোট ভাই মাসুক মিয়া (২৮) বাদি শাহপরাণ থানায় হত্যা মামলা নং ১৭/২০২৩ ইং ধারা ৩০২/৩৪ পেনালকোড-১৮৬০ দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছের থানার সাব-ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামানকে। মামলা দায়েরের বিষয়টি শাহপরাণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর রহমান গতকালই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এদিকে নিহতের স্ত্রীর অভিযোগ মামলার এজাহারে তিনি ৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করতে গেলে গিয়ে শুনতে পান নিহতের ছোট ভাই মাসুক বাদী হয়ে তড়িগড়ি করে হত্যা মামলাটি দায়ের করে ফেলেন, এবং তার এজাহারে তিনি ঘটনার সাথে জড়িত দুজনকে বাদ দিয়ে দেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি পুলিশের উর্ধ্বত কতৃপক্ষের সাথে দেখা করবেন।
জানা যায়, পীরেরচক এলাকায় দীর্ঘ দিন থেকে কতিপয় দুই সাংবাদিক ও স্থানীয় থানা পুলিশের সহযোগীতা নিয়ে অবৈধ ভাবে টিলা কেটে মাটি বিক্রি করে আসছিলেন অভিযুক্তরা। এনিয়ে রবিবার সকালে প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় নিহত আশিকের। এক পর্যায়ে টিলার মাটি কাটার মেশিন দিয়ে আশিকের বুকে সজোরে আঘাত করে মাটি খেঁকো চক্রের সদস্যরা। সে সময় ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। এই ঘটনার সময় মাটি খেকোঁচক্রের ৫ সদস্য উপস্তিত ছিলেন। স্থানীয়রা দ্রুত আশিককে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত আশিক মিয়ার স্ত্রী ফারজানা আক্তার কবিতার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এই হত্যাকান্ডের সাথে নিজেকে পুলিশ সদস্য পরিচয়দানকারী খোরশেদ, নামধারী দুই অনলাইন পত্রিকার সাংবাদিক, ও সার্জন নামের আরেক যুবক সরাসরি জড়িত রয়েছে। তাদের সেল্টারে বেশ কয়েকদিন থেকে টিলা কেটে মাটি বিক্রির ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো এই চক্রটি। তারা স্থানীয় থানার পুলিশকে ম্যানেজ করেই তাদের ব্যবসা করে আসছিলো। আশিক নিহত হওয়ার পর নিহত আশিক মিয়ার ভাই গতকালই তড়িগড়ি করে নিহতের স্ত্রীকে না জানিয়ে শাহপরান (রঃ) থানায় ৩ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন সেখান থেকে বাদ যায় ঘটনার সেল্টারদাতা ও পুলিশ সদস্য পরিচয়দানকারী খোরশেদ এর সহযোগী কতিত আরেক সাংবাদিকের নাম। নিহত আশিক মিয়ার স্ত্রী কবিতা আরো জানান, তার দেবর থাকেন ঘটনার স্থল থেকে অনকে দূরে। ঘটনার সময়ে তিনি উপস্তিত ছিলেন না। তাই উনি ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত দুইজনকে বাদ দিয়ে মামলাটি করেছেন। অথচ আমরা ৫ জনের নামে লিখিত অভিযোগ দিলে থানা মামলা নেয়নি। আমি বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যাব। সেখানেও আমাদের আবেদনপত্র গ্রহণ না করলে কোর্টে যাবো। তারপরও আমার স্বামী হত্যার জন্য দায়ীদের ছাড় দেবনা। এদিকে ২০মার্চ সোমবার ময়নাতদন্ত শেষে সিলেট নগরীর শাহ্ মানিকপীর রহঃ মাজারে নিহত আশিক মিয়ার দাফন সম্পুর্ন হয়েছে। নিহতের স্ত্রী কবিতা আরো জানান, আমার সাড়ে চার বছরের একটি সন্তান রয়েছে এবং আমি এখন ৮ মাসের অন্ত:সত্ত্বা।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘ দিন থেকে অবৈধ ভাবে টিলার মাটি কাটছে ঐ চক্রটি। তাদের কাজে বাধা দেওয়ায় এই চক্র পরিককল্পিত ভাবে প্রকাশ্যই আশিক মিয়াকে হত্যা করেছে। আসামীদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে কঠোর শাস্তির দাবী জানান তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় এক সময় মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে ছিল অসংখ্য পাহাড় ও টিলা। অনেক জায়গায়ই পাহাড় টিলার সেই দৃশ্য এখন আর নেই। নির্বিচারে টিলা কেটে সাবাড় করে ফেলছেন প্রভাবশালীরা। অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর যেনো নাকে সরিষার তেল লাগিয়ে ঘুমাচ্ছে। মিডিয়ায় খবর ছাপা হলে মাঝে মধ্যে নামকা ওয়াস্তে অভিযান চালালেও কার্যত টিলা কাটা থামছেই না। সিলেট নগরীর পরিধি বাড়ায় টিলা কাটায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। শীত, বর্ষা সব মৌসুমেই চলছে টিলা কাটা। মাটি কাটার পর টিলা যখন অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়, তখন অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদপ্তর।অন্যদিকে পরিবেশবাদীরা বলছেন, দিন-দিন মানবসৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। গত বর্ষা মৌসুমে এ ধরনের সংকট মোকাবেলা করতে হয়েছে সিলেটবাসীকে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সিলেট নগরীর বালুচর, মলাইটিলা, ব্রাহ্মণশাসন, হাওলদারপাড়া, খাদিমপাড়া, মেজরটিলা, দুসকি, টিলারগাঁও, খাদিমনগর, খাদিমপাড়া, গুয়াবাড়ী, জাহাঙ্গীরনগর, আখালিয়া বড়গুল এলাকার মুক্তিযোদ্ধা টিলা, নালিয়া, সাহেববাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় টিলা কাটা চলছে অহরহ। কোথাও প্রকাশ্যে আবার কোথাও রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে এসব টিলা। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে টিলা কাটার ফলে অনেক টিলা ধ্বসের ঘটনা ঘটেছে। জৈন্তাপুর, গোলাপগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় টিলা ধ্বসের ঘটনায় প্রাণহানিও ঘটেছে। এবার টিলা কাটায় বাধা দেওয়ায় প্রকাশ্যে খুন হলেন বাধা প্রদানকারী আশিক।
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ইমরান হোসেন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি দুই মাস থেকে ঢাকা ট্রেনিংয়ে আছি। মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি শাহপরাণ ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে দক্ষিন জোনের ডিসি মো. সোহেল রেজা বলেন, ঘটনার পরপরই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শণ করেছে। আসামীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া যদি কোন অভিযোগ এজাহার থেকে বাদ পড়ে যায় পুলিশী তদন্তে বেরিয়ে আসে, তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। মাটি কাটার সাথে কোন পুলিশ সদস্য জড়িত প্রমান পেলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৬৯৪ পড়েছেন