Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিবেদন: সিলেটের দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারের কুতুবপুর এলাকায় ট্রাক ও পিকআপের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। গুরুতর আহত হয়েছেন অন্তত আরো ১০ জন। হতাহতদের উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগর থেকে পিকআপে (সিলেট-ন ১১-১৬৪৭) করে প্রায় ৩০ জন নারী-পুরুষ নির্মাণ শ্রমিক জেলার ওসমানীনগর উপজেলার গোয়ালাবাজার যাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে ৫টার দিকে পিকআপ দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজার এলাকার কুতুবপুর নামক স্থানে মুনশীগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী বালুবহনকারী ট্রাকের (ঢাকা মেট্রো-ট ১৩-০৭৮০) সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে দক্ষিণ সুরমা থানা পুলিশ এবং সিলেট ও ওসমানীনগরের ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের একাধিক ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয়দের সহযোগিতায় হতাহতদের উদ্ধার করে ওসমানী হাসপাতালে প্রেরণ করে। ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনের স্পটডেটের বিষয়টি নিশ্চিত করেন ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামান। বাকি তিনজন হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা গেছেন। নিহতরা হলেন, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ মিয়া (৫০), শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া (২৫), একই উপজেলার বাবনগাঁ গ্রামের মৃত ওয়াহাব আলীর ছেলে শাহিন মিয়া (৪০), দিরাই উপজেলার আলীনগর গ্রামের মৃত শিশু মিয়ার ছেলে হারিছ মিয়া (৬৫), হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার হলদিউড়া গ্রামের আব্দুর রহিমের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪৫), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নূর (৫০), শান্তিগঞ্জ উপজেলার তলেরতন গ্রামের মৃত আওলাদ উল্লার ছেলে আওলাদ হোসেন (৬০), দিরাই উপজেলার পাথারিয়া গ্রামের মৃত ছলিম উদ্দিনের ছেলে একলিম মিয়া (৫৫), গচিয়া গ্রামের বারিক উল্লার ছেলে সিজিল মিয়া (৫৫), ভাটিপাড়া গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে সৌরভ মিয়া (২৭), নেত্রকোনার ভারহাট্টা উপজেলার দশদার গ্রামের ইসলাম উদ্দিনের ছেলে আওলাদ মিয়া (৩০), সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের শমসের নুরের মেয়ে মেহের (২৪), দিরাই উপজেলার মধুপুর গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে দুদু মিয়া (৪০), একই গ্রামের শাহজাহানের ছেলে বাদশা (২২) সহ ১৪ জন। দুর্ঘটনার পর নাজিরবাজারের দুদিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশের তৎপরতায় ৩ ঘণ্টা পর সাড়ে ৮টার দিকে সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে উপ-পরিচালক মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে সিলেট ফায়ার সার্ভিসের ৭টি টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে উদ্ধার কাজ চালায় এবং হতাহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। সংঘর্ষের পর শ্রমিক বহনকারী পিকআপটি রাস্তার পাশে পড়ে যায় এবং ট্রাকটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। নিহতদের সবাই পুরুষ।
দূর্ঘটনার খবর শুনে বিমানবন্দর থেকে হাসপাতালে মন্ত্রী: এদিকে সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের দেখতে হাসপাতালে ছুটে গেলেন সিলেট সফররত নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। বুধবার (৭ জুন) একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে সিলেট আসেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী। সকালে সিলেট ওসমানী ওসমানী বিমানবন্দরে নেমেই তিনি সরাসরি চলে যান এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রতিমন্ত্রী আহতদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। খালিদ মাহমুদ বলেন, আমাদের প্রথম কাজ নিহতদের চিহ্নিত করে তাদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা, তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে সরকার থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সরকারের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসার খরচ বহন করা হবে বলে জানান তিনি। এ সময় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়রপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, হাসপাতাল পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া।
হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি: এদিকে আহত-নিহতের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা। হাসপাতালে স্বজনদের খুঁজছেন অনেকেই। কেউবা স্বজনের কথা মনে করে অজ্ঞান হয়ে পড়ছেন। বুধবার সকালে এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল ওসমানী হাসপাতালের জরুরি বিভাগসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর অনুদান দিলেন আনোয়ারুজ্জামান: সিলেটের দক্ষিণ সুরমার নাজিরবাজারের কুতুবপুর এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে তাৎক্ষনিক আর্থিক অনুদান দিয়েছেন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। বুধবার (৭জুন) সকালে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়রপ্রার্থী আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। পরে হাসপাতালে গিয়ে হতাহতদের খোঁজ খবর নেন। এসময় তিনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে হতাহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকার অনুদান প্রদান করেন।
যেভাবে দূর্ঘটনা ঘটে: দূর্ঘনার কবল থেকে ভাগ্যক্রমে ফিরে আসা নিহত সায়েদ নুরের ভাই শের ইসলাম বলেন, ভোরবেলা সিলেট থেকে কাজের উদ্দেশ্যে ওসমানীনগর উপজেলার দিকে রওনা দিয়েছিলাম পিকআপ ভ্যানের সামনের সিটে বসে। ঢাকা সিলেট মহাসড়কের নাজিরবাজার এলাকায় হঠাৎ করে বিপরীতমুখী একটি ট্রাক আমাদের দিকে ছুটে এসে সজোরে ধাক্কা মারে আমাদের গাড়িতে। এরপরেই যেন মুহুর্তেই লÐভÐ হয়ে যায় আমাদের সবকিছু। বিপরীত থেকে আসা ট্রাকটি রাস্তার বামদিকে থেকেই সিলেটের দিকে এগুচ্ছিলো। আমাদের পিক আপ থেকে আনুমানিক ৫০ ফুট দূরে থাকা অবস্থাতেই আচমকা ডান দিকে ছুটে আসে তখন আমাদের গাড়ির ড্রাইবার ডান দিকে স্টিয়ারিং ঘুরালে সেও তার গতিপথ পরবর্তন করে আমাদের দিকে চলে আসে এবং দুর্ঘটনা ঘটে। মালবোঝাই ট্রাকটির ধাক্কার পর বিকট একটি শব্দ হয়। আমাদের গাড়িটিও দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যায়। কিভাবে হাত দিয়ে গাড়ির (পিক আপ ভ্যানের) গাড়ির গøাস ভেঙ্গে বাইরে এসেছি তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। সিলেটের মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ জানিয়েছেন,নিহতদের স্বজনরা তাদের নাম পরিচয় নিশ্চিত করেছেন। মরদেহগুলো সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহগুলো তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন নির্মাণ শ্রমিক পল্লব আহমদ (২৫) নামের এক তরুণ। সকাল ১১ টার দিকে সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘ঢাকার দিক থেকে আসা ট্রাকটি যখন ডান পাশে এসে আমাদের পিকআপটিকে ধাক্কা দেয়, তখন খুব জোরে শব্দ হয়েছিল। ট্রাকটি দ্রæতবেগে আসছিল। মনে হয়, চালক ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। ধাক্কা খেয়ে আমাদের পিকআপটি উল্টে যায়। আমি মাথায় আঘাত পাই। এরপর আর কিছু মনে নেই।’পল্লব সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়ার বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি সিলেট নগরের সাপ্লাই এলাকায় থাকেন।
৫৫৮ পড়েছেন