ছিনতাইকারীদের গডফাদার আব্দুস শহিদ : ৫ বছরে আলিশান বাড়ি-গাড়ি মালিক : রয়েছে ডজন খানেক মামলা
প্রকাশিত জানুয়ারি ১১, ২০২৫
সিলেটের ছিনতাইকারী চক্রের গডফাদার আব্দুস শহিদ ও তার সহযোগী ১ম স্ত্রী এবং ছিনতাইর টাকায় নির্মিত আলিশান বাড়ি।
Sharing is caring!
বিশেষ প্রতিবেদন: সিলেট নগরীতে প্রতিদিন প্রায় শতাধিক মোবাইল চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে । বিগত কয়েকদিন থেকে সিলেট নগরীতে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। মাঝেমধ্যে দু-একজন ছিচঁকে ছিনতাইকারী আটক হলেও মূলহোতার থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় জনমনে বিরাজ করছে আতংক। বিশেষ করে মোবাইল ছিনতাই যেন নিত্যনৈমত্তিক একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিনতাইকারীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না কেউই। গত এক মাসে সিলেট নগরীতে অর্ধশতাধিক চুরি-ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে জনমনে। নিরাপত্তাহীনতায় ভ‚গছেন নগরবাসী। ঘরে বাইরে তাদের এখন চুরি ও ছিনতাই আতঙ্ক তাড়া করছে।
তবে এবার এসব ছিনতাকারীদের গ্রেফতারসহ তাদের গডফাদারদের গ্রেফতারের জন্য এসএমপি পুলিশ কমিশনারের কঠিন নির্দেশের পর মাঠে নামছে একাধিকটিম। পোষাকধারী পুলিশের পাশাপাশি। সাদা পোষাকে ডিবির সদস্যরা মাঠে নেমেছে। অনেক ছিনতাইকারীকে ইতমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশও বিব্রত। এটি একটি লজ্জাজনক ঘটনা হয়ে দাড়িয়েছে। তবে এবার যে কোন ভাবে মুলহুতাদের গ্রেফতারের আওয়তায় নিয়ে আসতে চায় পুলিশ। ছিনতাইকারীদের গডফাদার আব্দুস শহিদের বিষয়টি এবার তাদের নজরে এসেছে। কোন ভাবেই ছিনতাইকারীদের ছাড় দেওয়া হবেনা। এমনটি জানালেন এসএমসপি মিডিয়া অফিসার সাইফুল ইসলাম।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিলেট নগরীর বন্দরবাজার ও কিনব্রিজ, জিন্দাবাজার, শাহজালাল মাজার, আম্বরখানা, কদমতলী বাস টার্মিনাল, উপশহর, শিবগঞ্জ, আম্বরখানা, টিলাগড়, তেররতন, ওসমানী মেডিকেল, রেলষ্টেশন, লাউয়াই, হুমায়ূন রশিদ চত্ত¡র এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছিনতাকারী সংঘবদ্ধচক্র বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে।
এসএমপির তথ্যমতে, নগরীতে গত নভেম্বরে ১৯টি চুরি, ৮ টি ছিনতাই ও একটি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর আগের মাস অক্টোবরে একটি ডাকাতি, ৫ টি ছিনতাই ও ১২টি চুরির ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় রিতিমতো প্রশাসনের ভ‚মিকাও প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। ছিনতাইকারীদের টার্গেট থেকে বাদ যাচ্ছেনা সাংবাদিক, পুলিশ সদস্য, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার ছাত্র, স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, চাকরিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী, ব্যবসায়ীসহ নগরীতে বিভিন্ন কাজে আসা সাধারণ মানুষ। সিলেট বন্দরবাজার এলাকার মোবাইল ছিনতাইয়ের ঘটনা প্রায় প্রতি ঘন্টায় একটি ঘটে থাকে।
মোবাইল ছিনতাই হলে পুলিশ কি করে : যে কারো মোবাইল ছিনতাই হলে থানায় গিয়ে জিডি করা ছাড়া আর কিছু করার থাকেনা ভ‚ক্তভোগীদের। কারণ প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও থানা পুলিশ এবিষয়ে মামলা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে একটি হারানো জিডি নিয়েই দায় সারেন পুলিশ। বছরের পর বছর গত হলেও এসব জিডির কোন অগ্রগতি থাকেনা। অভিযোগ রয়েছে এসব ছিনতাকারী চক্রের সাথে পুলিশের কতিপয় সদস্যদের একটি যোগসূত্র থাকায় পুলিশ মামলা নিতে চায়না। তাই বাধ্য হয়ে এখন আর মোবাইল ছিনতাই হলেও থানায় জিডি করতে চান না অনেকে। একদিক এসএমপি পুলিশ আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রনে নগরীতে ৭২টি সিসি ক্যামেরা লাগায় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কিন্তু বেশীর ভাগ ক্যামেরাগুলো এখন বিকল। গভির রাত হলে ছিনতাইকারীরাই এসব ক্যামেরা ভেঙ্গে দেয়। আর যে সকল ছিনতাকারীদের কষ্ট করে পুলিশ গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। কয়েক দিনের মধ্যেই একটি চক্র তাদের জামিন করিয়ে বাহিরে নিয়ে আসে। ফলে তারা আগের পেশাই বেছে নেয়। তবে এবার কমিশনারের নির্দেশে পুলিশ ভিন্ন পথে এসব ছিনতাইকারীদের প্রতিহত করতে মাঠে রয়েছে। মূল হুতাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে চায় তারা।
এসব ছিনতাই করে কারা : সিলেট নগরীতে ছিনতাইকারী কয়েকটি চক্র ছিনতাই কর্মকান্ড করে থাকে। তবে সকলের একজন গডফাদার রয়েছে আড়ালে থেকে তিনি এসব ছিনতাইকারীদের বিভিন্ন এলাকা ভাগ করে দেন। এই গডফাদারে নাম আব্দুস শহিদ (৩৫)। তার বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার সনকাপন গ্রামে। সে ঐ গ্রামের দিনমজুর মৃত নীল মিয়ার বড় ছেলে। বর্তমানে সিলেটের সবচেয়ে বড় মোবাইল ছিনতাইকারী চক্রের গডফাদার তিনি। মাত্র কয়েক বছর আগেও সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় শহিদ ফেরি করে মাছ বিক্রি করে জিবীকা নির্বাহ করতো। সেই শহিদ এখন সিলেট শহরের সবচেয়ে বড় ছিনতাইকারী চক্রের গডফাদার। সে এখন বসবাস করে এসএমপির দক্ষিণ সুরমা থানার শিববাড়ী এলাকার জৈনপুর গ্রামে। সেখানে ছিনতাইয়ের টাকায় গড়ে তুলেছে নিজস্ব তিন তলা বিশাল অট্টালিকা। এই শহিদ এক সময় মাত্র ৩৫ শত টাকায় বাড়া বাসা থাকতো সে এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক ছিনতাইকারী বলেন, সিলেট নগরী থেকে ছিনতাই হওয়া সকল দামী মোবাইল সাথে সাথে চলে যায় শহিদের কাছে। যে গুলো সহজে আইএসআই বদল করা যায় না সেগুলো তিনি বাসায় রাখেন নিজের ১ম স্ত্রীর হেফাজতে একটি গোপন স্থানে। সারা মাসের ছিনতাই হওয়া মোবাইলগুলো পরে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেন। বিনিময়ে ভারতের ছিনতাই হওয়া আরেকটি মোবাইলের চালান আসে শহিদের হাতে। যা তিনি নগরীর বিভিন্ন দোকানে পাইকারি বিক্রি করে থাকেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় ছিনতাই হওয়া মোবাইল কার্টন ভর্তি করে আসে শহিদের বাসায়। কখনো ট্রেনে কখনো বা বাসে বস্তাবন্ধি করে এসব হাজার-হাজার ফোন আসে তার কাছে। কারণ সারাদেশ রয়েছে আব্দুস শহিদের একটি মোবাইল চোরাই নেটওয়ার্ক কানেকশন। এমনটা জানিয়েছেন শহিদের একাধিক গণিষ্টজনসহ তার সাবেক স্ত্রী তামান্না আক্তার। ছিনতাইকারীরা বলেন শহিদের নেতৃত্ব সিলেট নগরীসহ সারাদেশে প্রায় দুই শতাধিক ছিনতাইকারী দিনে-রাতে মোবাইল ছিনতাইয়ের কাজ করে থাকেন। তার ছিনতাই কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তার সুন্দরী স্ত্রী, ছোট ভাই আয়ূব আলী বন্ধু মিজান ও ভাতিজা আল আমিন।
ছিনতাইয়ের মোবাইল কি করা হয় : ছিনতাইকৃত মোবাইলের আইএমআই পরিবর্তন করার জন্য সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমায় আব্দুস শহিদের ছোট আয়ূব আলী নিজেই একটি মোবাইলের দোকান দিয়েছেন। আর ভাতিজা আল আমিন, বন্ধু মিজান সারা দিন সিলেট নগরীর বিভিন্ন মার্কেটে গিয়ে এসব মোবাইলের আইএমআই ও মাদারবোর্ড পরিবর্তন করে থাকেন। পরে শহিদ নিজেই নিজের নির্ধারিত দোকানে অল্পদামে তা সেল করে দেন। তবে শহিদ নিজেকে ব্যবসা বলে মানুষের কাছে দাবী করেন। তিনি শুধু ছিনতাইয়ের মোবাইলই কেনা-বেচা করেন বলে সিলেট নগরীর একাধিক ব্যবসা জানান। এছাড়া মিজানের একটি দোকান রয়েছে এসএমপি দক্ষিণ সুরমা থানার সিলাম এলাকায়। ছিনতাইকৃত মোবাইলের আইএমআই পরিবর্তন করা গেলে মাত্র ৩০ মিনিটি মোবাইলটি দোকানে সেল করে দেন আব্দুস শহিদ। সিলেট নগরীর করিম উল্লাহ মার্কেট থেকে জিন্দাবাজার, আম্বরখানার চায়না মার্কেটের প্রায় ১০ টি দোকানে আব্দুস শহিদ ছিনতাইকৃত মোবাইলের আইএমআই পরিবর্তন করে বিক্রি করে থাকে। তা সিলেট নগরীর সকল মোবাইল ব্যবসায়ীর জানা রয়েছে। আরেকটি সূত্র জানায়, পুলিশের কতিপয় দুই একজন সদস্য শহিদের কাছ থেকে বখরা নিয়ে থাকে বিভিন্ন মামলা থেকে বাঁচিয়ে রাখেন। অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, শুধুমাত্র মোবাইল ছিনতাই টাকা দিয়ে আব্দুস শহিদ চারটি সিএনজির মালিক হয়েছেন। শাহপরান এলাকায় কয়েক লাখ টাকা খরচ করে দিয়েছেন একটি বিউটি পার্লার। শহিদের মালিকানা সিএনজি দিয়ে প্রতিদিন একটি চক্র নগরীতে যাত্রীদের মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনতাই করে থাকে।
পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়: এক সময় আব্দুস শহিদ সিলেট নগরীতে নিজেই ছিনতাই কাজ করতো। ঐ সময় তার সম্পর্ক গড়ে উঠে নগরীর বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্রের সাথে। সেই চক্রের ছিনতাইকৃত মোবাইল বিক্রির দায়িত্ব নেয় শহিদ। ধিরে ধিরে ছিনতাইকারী একাধিক চক্রের একক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শহিদের হাতে। শুধু ছিনতাইয়ের মোবাইলসহ নানা পন্য বিক্রি করে শহিদ এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। সিলেট নগরীর দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরে রয়েছে তার তিনতলা একটি আলিশান বাড়ি। সেটি তৈরী করতে শহিদ প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করেছে। হঠাৎ করে কোটিপতি হওয়া শহিদ প্রথম স্ত্রী ঘরে রেখে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে আরো দুটি বিয়ে করে গোপনে। তবে পরে বিয়ের খবর গুলো গোপন রাখতে পারেনি। চতুর শহিদ শেষের কোন বউকে কাবিননামা দিতেন না। কাজী আর সাথের বন্ধুদের ডেকে বিনা কাবিনে বিয়ে করে সংসার করতেন প্রথম স্ত্রীকে গোপন রেখে। পরে প্রথম স্ত্রী বিয়ের বিষয় জানলে কাবিন ছাড়া বউদের প্রথমে অস্বীকার করতেন। চাপে পড়লে টাকা-পয়সা দিয়ে বা পুলিশ দিয়ে হুমকি-ধামকি দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে দিতেন। সর্বশেষ আব্দুস শহিদ বিয়ে করেন সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার জিগলী রাইতলা গ্রামের নুর উদ্দিনের মেয়ে সুন্দরি তামান্না বেগম। তামান্নার পরিবার এখন জালালাবাদ এলাকার মাসুক বাজারে বসবাস করেন। তামান্নাকে বিয়ে করে শহিদ প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে পৃথক বাসায় সংসার করতে গিয়ে ১ম স্ত্রীর কাছে ধরা পড়লে পুলিশের সহায়তায় বিয়ের বিষয়টি মাত্র এক লক্ষ টাকা দিয়ে ধামাচাপা দেন। মাত্র কয়েক বছরের শহীদ মাছ বিক্রেতা থেকে সকলের কাছে মোবাইল চোর সিন্ডিকেটের গডফাদার হিসাবে পরিচয় লাভ করেন। সময়ের সাথে-সাথে গড়ে উঠেছে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে গভির সম্পর্ক।
সিলেট কোতয়ালী থানা হাজতে ছিনতাইকারীদের গডফাদার শহিদসহ তার সহযোগীরা।
পুলিশি তথ্য মতে, বিগত ২০২৩ সালে ১০ ফেব্রুয়ারী রাতে বন্দরবাজার থেকে তিন ডাকাতকে আটক করে পুলিশ। পরে তাদের স্বীকারোক্তিতে আব্দসু শহিদকে জৈনপুর তার বাসা থেকে গ্রেফতার করে কতোয়ালী পুলিশ। যদিও এর আগেও আব্দুস শহিদ র্যাব-পুলিশের হাতে একাধিক বার গ্রেফতার হয় এবং জামিনে ছাড়া পায়। ঐ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মিজানুর রহমান আব্দুস শহিদকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দশ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে এসআই মিজানুর রহমান নগদ তিনলাখ টাকা দিয়ে আব্দুস শহিদকে রিমান্ডে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করে জামাই আদর দিয়ে পরদিন তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। বিনিময়ে আব্দুস শহিদের সাথে মিজানের চুক্তি হয় প্রতিমাসে শহিদ ছিনতাইকৃত মোবাইলের টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা এসআই মিজানকে দিবেন। এই আব্দুস শহীদের নেতৃত্বেই বিগত ৫ বছর থেকে এখন পর্যন্ত সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সঙ্গবদ্ধ ভাবে মোবাইল ও মহিলাদের ভ্যানেটি ব্যাগ, পকেট মারা সহ, ছিনতাই কর্মকান্ড ঘটে থাকে। সিলেটের অপরাধ জগতে বিচরণ করা এই শহীদ এখন ছিনতাইকারী ও ডাকাত চক্রের গডফাদার। প্রতিটি ছিনতাইয়ের তথ্য শহিদের কাছে রয়েছে। তবে এখন শহিদ নিজে আর ছিনতাই করেন না। তিনি সহযোগীদের দিয়ে ছিনতাই করান। তিনি সহ তার কিছু সহযোগী সারাদিন সিলেট নগরীর বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, আম্বারখানা, দক্ষিণ সুরমা, সুরমা মার্কেট এলাকায় ঘুরে বেড়ান। দামী মোবাইল ব্যবহারকারীদের টার্গেট করে তার বাহিনীর সদস্যকে তথ্য ও পোষাকের বিবরণ বলে দেন। বিকাল হলে তিনি ব্যস্থ থাকেন চোরাইকৃত মোবাইলের আইএমই নাম্বার বদল আর বিক্রি করতে। মাত্র কয়েক বছরে শহিদ ছিনতাইর টাকায় তিনতলা আলিশান বাড়িটি তৈরী করলেও বাড়িটির কাগজপত্র নিজের নামে করেননি। বাড়ির মালিকানা দিয়েছেন তার প্রথম স্ত্রীর নামে। অথচ একসময় শহিদের প্রথম স্ত্রীর মা সিলেট কেন্দ্রীয় বাস ট্রার্মিনালের একটি টিনের টং দোকানে ভাত-মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। শহিদ সেই দোকানে মাছ ছাপ্লাই দিতে গিয়ে প্রথম স্ত্রীর সাথে পরিচয়ও পরে বিয়ে করেন।
কোতয়ালী পুলিশ সূত্র জানায়: এক সময় নিজেই ছিনতাই করতো আব্দুস শহীদ। কয়েক বছর ধরে সে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করে। তার নেটওয়ার্কের কে কোথায় যাবে। কে কি করবে এসব বিষয়ে তদারকি করে সে। পাশাপাশি কোনো সদস্য গ্রেফতার হলে তাকে ছাড়িয়ে আনার কাজও করে শহিদ। ফলে তার সিন্ডিকেটের সদস্যদের বেশিদিন জেলে থাকতে হয়না।
শহীদের বিরুদ্ধে কত মামলা: ভয়ঙ্কর অপরাধী শহীদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সিলেটের কোতোয়ালিসহ বিভিন্ন থানায় প্রায় ডজন খানেক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ পর্যন্ত শহিদের বিরুদ্ধে ৯টি মামলার কাগজ এ প্রতিবেদকের কাছে এসেছে। সবগুলা মামলাই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায় তার বিরুদ্ধে এসব মামলা দায়ের করা হয়। গ্রেফতার এড়াতে শহীদ দক্ষিণ সুরমার শহরতলীতে অবস্থান করে পুরো নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করে, প্রায় ১৫ বছর ধরে সিলেট শহরে বসবাস করে আসছে শহিদ। সে দক্ষিণ সুরমা ও টুকেরবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় প্রথমে বসবাস করলে এখন জৈনপুরে কয়েক কোটি টাকার জায়গা কিনে বিশাল আলিশান বাড়ি তৈরী করেছে। বিভিন্ন রুটে সিএনজি অটোরিকশায় ছিনতাই করতে তার নেতৃত্বে একটি টিম গড়ে ওঠেছে। এই টিমের সদস্যরা দিনের বেলা চুরি, ছিনতাই ও রাতে ডাকাতি করে। এসব ঘটনায় নিয়মতি মামলাও হয় তাদের বিরুদ্ধে। এখন শহিদের নেতৃত্বে শুধু সিলেটে ৫০-৬০ জনের একাধিক ছিনতাইকারী চক্র কাজ করছে সিলেট শহরে।
পুলিশ কমিশনারের কাছে শহিদের ২য় স্ত্রী তামান্না ও তার পরিবার যে অভিযোগ করেন: তামান্না বেগম সহ তার পরিবার শহিদের কাছে এখন জিম্মি। তিনি পুলিশ কমিশনার ও এসপি অফিসে লিখিত অভিযোগ করে বলে ছিলেন শহীদ একাধিক বিয়ে করেছে। এ পর্যন্ত তিনটি বিয়ের খবর পাওয়া গেলেও মাত্র একটি বিয়ের কাবিন রয়েছে। বাকিগুলো কাবিন ছাড়া বিয়ে ছিলো তার। পরে প্রথম স্ত্রীর চাপে পড়ে টাকা দিয়ে তিনিসহ পরের স্ত্রীদের বিদায় করে দেয়।
হত্যা মামলা থেকে শহিদ যে ভাবে রক্ষা পায়: সুনামগঞ্জের ছাতক থানার জিগলী রাইতলা গ্রামের নুর উদ্দিনের ছেলে আলীকে ছিনতাই করতে গিয়ে কিনব্রিজের উপরে খুন করে শহিদসহ তার সহযোগীরা। আলী খুনের ঘটনায় শহীদসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের পিতা। সেই মামলার এজাহারভুক্ত তিন নাম্বার আসামী ছিলো ছিনতাইকারী শহিদ। পরে শহিদ বিষয়টি টাকার বিনিময়ে আপোষে শেষ করে এবং প্রলোভনে ফেলে বিয়ে করে নিহত আলীর ছোট বোন তামান্না বেগমকে। অথচ তামান্না এর আগে শেখঘাট এলাকার আরেকটি হিন্দু ছেলেকে প্রেম করে বিয়ে করে। তাদের একটি মেয়ে সন্তানও রয়েছে। আগের স্বামী মারা গেলে তামান্না পিতার বাসায় আশ্রয় নেন। সেখানে পরিচয় হয় শহিদের সাথে। পরে প্রলোভনে ফেলে কাবিন ছাড়া তামান্নাকে বিয়ে করে শহিদ। প্রথমে নিজ বাসায় নিয়ে গেলে প্রথম স্ত্রীর সাথে দ্বন্ধ সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে পরে পৃথক একটি বাসায় নতুন সংসার শুরু করে শহিদ-তামান্না। সেই বাসায় বস্তায়-বস্তায় চোরাই ফোন আসতো বলে তামান্না তার লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন। পরে প্রথম স্ত্রীর চাপে শেষ পর্যন্ত তামান্নাকে একাধিক বিচার শালিশে মাধ্যমে মাত্র ১ লাখ টাকা দিয়ে বিদায় করে শহিদ। সেই থেকে তামান্নার ভাইদের ছিনতাইকারী সাজিয়ে হয়রানী করে আসছে শহিদ। সেই লিখিত অখিভযোগের কপি ও রেকর্ড এ প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
একাধিক ছিনতাইকারী নাম প্রকাশ না করে জানান, শহিদ প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে জৈনপুরে একটি কলোনীতে মাত্র পয়ত্রিশ শত টাকায় বাড়া থাকতো। এখন শহীদ প্রায় ১০ কোটি টাকার মালিক। সিলেটের কয়েকটি ব্যাংকে এখন শহিদের একাউন্ট রয়েছে।
সিলেটের বিভিন্ন তাফসির মাহফিল আর বিপিএল খেলা ঘিরে শহিদের মিশন : সিলেটের বিভিন্ন তাফসির মাহফিল, বিপিএল খেলা, ও মিছিল মিটিং ঘিরে শহিদ তার দলের সদস্যদের কয়েকটি ভাবে ভাগ করে দেয়। ছিনতাই করতে গিয়ে কোন সদস্য জনতার হাতে ধরা পড়লে বাকি সদস্যরা গিয়ে সেই সদস্যকে উত্তম মাধ্যম দেওয়া অযুহাতে ছেড়ে দিবেন। সেই ছিনতাইকারী পরে জনতার মাঝে মিশে যাবে। একাধিক স্থানে থাকবে সিএনজি ও মটরসাইকেল নিয়ে দাড়ানেরা চক্রের বিভিন্ন সদস্য তারা তাকে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যাবেন। শহিদের হয়ে কাজ করে এরকম একাধিক ছিনতাইকারী এ প্রতিবেদকের কাছে এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা রেকর্ড আকারে রয়েছে।
র্যাব-৯ এর একটি সূত্র জানায়: গত বছরের ১১ জুন তাদের একটি টিম অভিযান চালিয়ে শহিদের সহযোগী জিবুল ইসলাম জেবলু (২২), মো. আব্দুর রহিম (২৮), মো. মাসুদ মিয়া (২৩), মো. ইমন (২২), মিজানুর রহমান (২২), আব্দুর রহমান (২২) নামের চারকে আটক করে। এসময় তাদের কাছ থেকে ২৩১টি স্মার্ট মোবাইল, ১০টি বাটন মোবাইল, ১০টি ট্যাব, ২টি পিসি, ৩টি মনিটর, ২টি কিবোর্ড, ২টি মাউস, ১টি হার্ডড্রাইভ, ২টি পেনড্রাইভ, নগদ ৭৫ হাজার ৫৫০ টাকা এবং ১টি আইএমইআই পরিবর্তনকারী ডিভাইস জব্দ করা হয়। এরা সিলেট শহরের বিভিন্ন জনবহুল এলাকায় একাধিক সংঘবদ্ধ মোবাইলু চুরি ও ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় রয়েছে। খুবই অল্প সময়ে চুরি-ছিনতাইয়ের কাজ শেষে তারা দ্রæত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে চুরি ও ছিনতাইকৃত এসব মোবাইল পরবর্তীতে আইএমইআই পরিবর্তন করা হয়। পাশাপাশি তারা মোবাইলের কেসিন, ডিসপ্লেও পরিবর্তন করে ফেলে। অনেক ক্ষেত্রে এসব মোবাইল বিভিন্ন অপরাধ করার জন্য অপরাধীরা কিনেন। গ্রেপ্তারকৃত এই চক্রটি দীর্ঘদিন যাবত মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে বিক্রি করেছে বলে জানা যায়। ব্র্যান্ড এবং কোয়ালিটি ভেদে এসব মোবাইলের দাম বিভিন্ন পরিমাণ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। গ্রেপ্তারকৃত এই চক্রটি প্রায় ২০–২৫ হাজারের অধিক মোবাইলের আইএমইআই পরিবর্তন করে বিক্রি করেছে বলে জানায়। তারা ব্র্যান্ড ও কোয়ালিটি ভেদে কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিটের মধ্যেই যে কোনো মোবাইলের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করে।
সংবাদ প্রচার বন্ধ রাখতে শহিদ যে তৎপরতা চালায়: এদিকে সংবাদপত্রে যাতে নিজের ছিনতাই কানেকশনের খবর প্রকাশ না হয় তার জন্য ভিবিন্ন প্রন্তা অবলম্বন করে শহিদ। কোথায় তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হলে সেই সংবাদ বন্ধ করে দিতে বা নাছাপাতে তার কাছ থেকে সুবিধা নেওয়া কিছু লোক দিয়ে তদবির শুরু করেন। যে তদবিরের প্রমান এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। এমনকি তার সহযোগী সংবাদ প্রচার করলে সাংবাদিকদের মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি দিয়ে থাকে।
এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম আরো বলেন: জনসাধারণকে আশ্বস্থ করা ও নিরাপত্তা দেয়াই পুলিশের কাজ। পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে অপরাধীদের গ্রেফতারও করছে। খুব শীগ্রই এর সাথে জড়িতদের গ্রেফতার হবে। এর জন্য এসএমপি পুলিশ কমিশনারের পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে প্রতিদিন। তাই এখন মাঠে পুলিশের পাশাপাশি এসএমপির ডিবির সদস্যরা কাজ করছেন। কমিশনারের নির্দেশ যে কোন ভাবে নগরীর এইসব ছিনতাইকারীদের আইনের আওয়াতায় নিয়ে আসার জন্য। তাই এ পর্যন্ত বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। বাকিদের আটক করতে সাড়াসি অভিযান চালুনো হবে।
(পরের ধারাবাহিকে থাকছে (ছিনতাইকারী শহিদের পুলিশ কানেকশন, যে সকল সাংবাদিক ছিনতাইর স্বীকার , একাধিক বিয়ের কাহিনী, ছিনতাইকারীদের দেওয়া বক্তব্যর ভিডিও) ।
৭৫ পড়েছেন