Sharing is caring!
সম্পাদকীয়: বাংলাদেশের সংবিধানে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ বলতে মূলত অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে বোঝানো হয়েছে [অনুচ্ছেদ ১৫(ক)]। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো জীবনধারণের মৌলিক উপকরণাদি ন্যায্যমূল্যে জনগণের কাছে সহজলভ্য করা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এ দেশে ন্যায্যমূল্যে জীবনধারণের মৌলিক উপকরণাদি প্রাপ্তি একটি দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মৌলিক উপকরণাদির আকাশচুম্বী দাম যখন এক দিকে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে, তখন অন্য দিকে তাদের আয় হ্রাস, মূল্যস্ফীতি দারিদ্র্যহারকে ঊর্ধ্বমুখী করেছে। কেন এমন হচ্ছে তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। মৌলিক উপকরণগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে অন্ন। অন্ন বলতে সাধারণত ভাতকে বোঝায়। চাল থেকে রূপান্তরিত ভাত দেশের ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য। ভাত আমাদের ক্যালরির প্রধান উৎস। গত দেড় যুগে এ খাদ্যপণ্যটির দাম বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ গুণ। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে সচিব ছিলাম। ২০০১-০২ অর্থবছরে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মোটা আমন চাল কেজিপ্রতি ১২ টাকা ৫০ পয়সা এবং বোরো চাল কেজিপ্রতি ১৩ টাকায় কিনেছিল। উল্লেখ্য, ধান কাটা-মাড়ার মৌসুমে সরকারের সংগ্রহ অভিযান শেষে খোলা বাজারে পণ্যটির দাম সাধারণত সরকারের সংগ্রহমূল্যের চেয়ে কিছুটা বেশি থাকে। চলতি আমন মৌসুমে সরকার প্রতি কেজি মোটা চাল ৪২ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী বৈরী আবহাওয়ায় চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে পণ্যটির উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়া এবং দেশে উৎপাদিত ধান-চালের ব্যবস্থাপনায় সরকারি দুর্বলতার কারণে বাজারে প্রতি কেজি মোটা আমন চাল কমবেশি ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, গত দেড় যুগে সাধারণ মানুষের আয় কি ৪০০ গুণ বেড়েছে? একাধিক কারণে চালের উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের জীবনে ভীতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট ব্যয়ের ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। আবার মাসিক মোট খরচের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। তাই চালের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ছে। দুই. চালের, বিশেষ করে মোটা চালের দাম বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব ওই চালের সব শ্রেণির ভোক্তার ওপর পড়লেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দদ্রি ও হতদরিদ্র পরিবারগুলো। তিন. শুধু দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা নয়, চালের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দিতে হচ্ছে। প্রধান খাদ্যশস্য চাল ছাড়াও খাদ্যের অন্যান্য উপাদান যেমন-আটা, ময়দা, ডিম, ভোজ্যতেল, মাছ-মাংস, দুধ, মসলা, ফল ইত্যাদির উচ্চহারে মূল্যববৃদ্ধি ঘটেছে। এতে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের পক্ষে আমিষজাতীয় খাদ্য কেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ফলে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও মহিলাদের পুষ্টির অভাব ঘটছে। জীবনধারণের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো স্বাস্থ্যসেবা। ২০১৯ সালে প্রকাশিত বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সূচকে বৈশ্বিক গড় মানের (স্কোর ৪২.২) চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ। ৩৫ স্কোর নিয়ে ১৯৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান ও নেপাল। গত ৭ এপ্রিল একটি দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে গত দুই দশকে স্বাস্থ্য খাতের অবকাঠামোগত উন্নতি হলেও অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে চিকিৎসাবৈষম্য বেড়েছে। এ কারণে চলমান স্বাস্থ্যব্যবস্থায় চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমছে না। চিকিৎসা খরচের ৬৭ শতাংশের বেশি যাচ্ছে ব্যক্তির পকেট থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশে যেখানে বিনামূল্যে ও সহজ উপায়ে জনগণকে চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়, সেখানে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। অন্য এক সূত্রে জানা যায়, সার্কভুক্ত দেশগুলোয় স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির পকেট খরচ মালদ্বীপে ১৮, ভুটানে ২৫, শ্রীলংকায় ৪২, নেপালে ৪৭, পাকিস্তানে ৫৬ আর ভারতে ৬২ শতাংশ, অর্থাৎ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি। ফলে স্বাস্থ্যের ব্যয় মেটাতে গিয়ে আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাসস্থান মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম ও শহরাঞ্চলে বাসস্থানের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিতভাবে বাসস্থান নির্মাণের জন্য গ্রামাঞ্চলে নষ্ট হচ্ছে প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান কৃষিজমি। বর্তমান সরকার গ্রামাঞ্চলে পরিকল্পিত বাসস্থান নির্মাণ কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এদিকে কর্মসংস্থান, উন্নতমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার জন্য শহরমুখী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। জমি ও নির্মাণসাগ্রী ক্রয় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বেশ কয়েক বছর আগেই শহর ও গ্রামাঞ্চলে বাড়ি নির্মাণ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিসহ আরও কিছু কারণে বিশ্বব্যাপী যে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে, বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। এ কারণে জমি, নির্মাণসামগ্রীর দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি নির্মাণ ব্যয় আরও বেড়ে গেছে। তাছাড়া শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা ও অন্যসব মহানগরীতে হোল্ডিং কর বেড়ে যাওয়ায় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে গেছে। এসব কারণে বাড়ি ভাড়া বেড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকায় ৮০ ভাগের বেশি মানুষ ভাড়া বাড়িতে বাস করে এবং তাদের আয়ের একটি বড়ো অংশ বাড়ি ভাড়ায় ব্যয় হয়। বিশেষ করে যারা সীমিত আয়ের ভাড়াটিয়া, বাড়ি ভাড়া মেটানোর পর তাদের সংসার নির্বাহ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। জীবনধারণের আরেকটি মৌলিক উপকরণ হলো শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত বেসরকারি খাতভিত্তিক হওয়ায় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউশন ফি, পরীক্ষা ফি ইত্যাদির পরিমাণ অনেক বেশি বিধায় ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা ব্যয় বেড়েই চলেছে। তাছাড়া নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে শ্রেণি শিক্ষার মান সন্তোষজনক না হওয়ায় শহর ও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট ও কোচিংয়ের দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকছে। প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যয় মেটাতে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। ইউনেসকোর মতে, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশের জোগান আসে পরিবারগুলো থেকে, যা শিক্ষা খাতে পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। শিক্ষা খাতে খরচ মেটাতে এসব পরিবার সংসারের অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে পারছে না। খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো উচ্চ হারে ব্যয় বৃদ্ধি না ঘটলেও জীবনধারণের আরেকটি উপকরণ বস্ত্র খাতেও কিছুটা মূল্যবৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। তাছাড়া জীবনধারণের অন্যান্য উপকরণ যেমন-যাতায়াত, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, বিনোদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে, যার ফলে শহরাঞ্চলের পরিবারগুলোর ব্যয় বহুলাংশে বেড়েছে। বিগত দুই অর্থবছরে করোনা মহামারির কারণে বেসরকারি খাতে চাকরিচ্যুতি, বেতন,মজুরি হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে মানুষের আয় কমেছে। বেড়েছে বেকারত্বের হার। ওয়াশিংটনভিত্তিক জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ পরিচালিত ‘স্টেট অব দ্য গেøাবাল ওয়ার্কপ্লেস ২০২১’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনা মহামারির সময়ে বিশ্বে প্রতি তিনজনের একজন চাকরি বা কাজ হারিয়েছেন। ফলে মানুষের আয় কমেছে। সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, করোনার সময় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫৫ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবে খাদ্যশস্যের উৎপাদনে নিম্নমুখিতা, ডলারের উচ্চমূল্য, মূল্যস্ফীতির উচ্চহার ইত্যাদি কারণে মানুষের প্রকৃত আয় আরও হ্রাস পেয়েছে। জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলো এবং অন্যান্য উপকরণের উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি সব শ্রেণির মানুষের, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্রদের শ্রেণিগত অবনমন ঘটাচ্ছে। নিম্নবিত্তরা দরিদ্রে এবং দরিদ্ররা অতিদরিদ্রে পরিণত হচ্ছে। করোনার আগে (২০১৮-১৯ অর্থবছরে) দেশে দারিদ্র্যহার ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে বলে সরকার দাবি করলেও করোনা-পরবর্তী সময়ের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার কত তা প্রকাশ করা হচ্ছে না। তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মতে, দেশে দারিদ্র্যহার ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। তাই সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধিসহ জীবনধারণের উপকরণগুলো তাদের কাছে ন্যায্যমূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। অন্যথায় সামাজিক কাঠামোতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।
৪৭৩ পড়েছেন